সুত্র ধরলেন উমাপদ কর
আমি এবার দেবাঞ্জনকে কবিতা পড়তে বলবো। দেবাঞ্জন শূন্য দশকের কবি, দশক বিচার
করলে। দশক যদিও বা আমরা সেভাবে অতটা মানিনা, কিন্তু প্রকাশ বিকাশ যদি হয় তাহলে
তাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার যে দশ বারোজন শূন্য দশকের কবি প্রথম তালিকায় আছে তার
মধ্যে দেবঞ্জন দাস একজন। দেবাঞ্জন দাসরা, ওদের বৈখরী ভাষ্য, যে পত্রিকা ওরা করত
তাদের যে দলবল ছিল, দেবা ইন্দ্র অর্ঘ্য অনির্বাণ অমিতাভ অরূপ, তো এরা একেকজন
একেকভাবে কবিতা লিখেছে। কেউ কারও মত নয়। এরা, এটা ঠিক, আটের দশকের বা সাতের দশকের
কিছু কবির কবিতা অসম্ভব আত্মস্থ করেছে, এটা ওদের কবিতা পড়লে বোঝা যায়, কারণ ওখান
থেকে কীভাবে ডিপার্ট করতে হয় কবিতাকে, ওই জ্যর থেকে, সেটা ওরা করায়ত্ত করেছে। এরা
সেভাবে “নতুন কবিতা” কখনও লেখেনি। 'নতুন কবিতা' বারীন ঘোষালের একটা কয়েনেজ।
কিন্তু, এদের কবিতা চেতনা ও কবিতা শৈলীর মধ্যে একটা অন্যরকম ধারা, যা প্রথার সাথে
একেবারেই যায়না। এরা 'নতুন কবিতা'র কোনও কপি করেনি। 'নতুন কবিতা' র কপি বেশ কিছু
লোক করেছে, করার চেষ্টা করেছে। হতোদ্যম হয়ে ফিরে গেছে। কেউ বন্ধ করেছে। কেউ
চালিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু শূন্য দশকের এই কবিকূল, এরা আশি ও নব্বই দশক থেকে নিজেদের
ঋদ্ধ করেছে। তারপর সেখান থেকেও ডিপার্ট করে নিজেদের কবিতাটা লিখেছে এবং আরও
ফ্যান্টাস্টিক জায়গা হচ্ছে, এদের মকশো পিরিয়ড যেভাবেই হোক খুব ছোট। খুব অল্প দিনের
মধ্যেই এরা নিজেদের কন্ঠস্বরটাকে একটা গ্রামে পৌঁছানোর মত অবস্থায় এনেছে। এখন
'অপরজন' নামে একটা ওয়েব পত্রিকা ও করে। যদিও পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস দত্ত। তবু,
পত্রিকা মূলত দেখে ও। এটা একটা মাসিক পত্রিকা। ভালো কাজ করছে। ডকুমেন্টেশন করার মত
বেশ কিছু কাজ এরা অলরেডি করে ফেলেছে। এই পত্রিকাটা অনেকে পড়ে। খুব রিসেন্টলি ওরা
একটা কাজ করেছে। আটজন সম্পাদককে দায়িত্ব দিয়ে (অর্থাৎ ওরা দেখতে চাইছে পরের
ছেলেমেয়েরা) প্রথম দশকের চুয়ান্নজন কবির কবিতাকে এক জায়গায় এনেছে। যেটা স্বপন
করেছে, আমি করেছি, আমি লিখেছি, স্বপন কিছু কিছু লিখেছে। এই যে কাজ, এই কাজের মধ্যে
আছে, ইন্দ্রনীল সহায়তা করে। এবং ইন্দ্রকে ওরা সহ সম্পাদক হিসেবে নিয়েছে। তো কবিতায়
আসি। কবিতার ক্ষেত্রে 'বিল্লিবাদল' এর পর ও আর বই করেনি। মোট দুটো বই। প্রথম বই
'চেনা আনফ্রেম' নিয়ে ওকে চিঠিও লিখেছিলাম। তো যাই হোক, পড়ুক এবার ও। পড়-
দেবাঞ্জন দাসের কবিতা
............
উমাপদ কর
পার্থ এবার দেবাঞ্জনের কবিতা নিয়ে কিছু বল।
পার্থসারথি ভৌমিক
ওর কবিতা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই কিছু প্রাককথন এসে পড়ে, আমি সেটা এড়াতে
পারব না, কারণ দেবাঞ্জন আর আমি একই জায়গায় বড় হয়েছি। দেবাঞ্জনকে আমি খুব ছোট থেকে
চিনি। ওর পরিবারের সাথেও আমার একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে। দেবাঞ্জন ছেলেবেলায়
আবৃত্তি করত। তারপর ও যখন যাদবপুরে ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে পড়তে গেল, তারও হয়তো বছর
কয়েক আগে থেকেই, ও লেখা শুরু করেছে। তো ওকে আমি বলেছিলাম, তুমি যখন লিখছ, তুমি
একটা বই যত তাড়াতাড়ি পারো করো। কারণ ওর অনেক লেখা হয়ে গেছে। এবং তন্ময়ের ক্ষেত্রে
আজ চিত্তদা যা বললেন, কিছু লেখা জমা হয়ে যাওয়ার পর, সেটা যদি ইতিহাস করতে হয়, সেটা
ছাপানো খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ আজ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেউ লিখল কিছু,
সেটাকে সে ছাপল ২০২৫ সালে। তার তলায় সে লিখলো, এটা ২০২০ সালে আমি লিখেছি। তার
বিশ্বাসযোগ্যতা ইতিহাস দেবেনা। কাজেই ২০২০র- ফেব্রুয়ারির লেখা যদি ২০২১ এর ফেব্রুয়ারির
মধ্যে কোথাও না কোথাও ছাপানো যায়, তাহলে সেটা ইতিহাস হতে পারে। কিন্তু খুব বেশি
পিছিয়ে গেলে তার ঐতিহাসিক মুল্যটা প্রমাণিত হয় না । দেবাঞ্জন আমাকে কাকু বলে ডাকে।
দেবাঞ্জন যখন 'জল ও জাহানারা' লিখলো, তখন ও আমাকে বলল পার্থ কাকু, এটা লেখার পরে
মনে হচ্ছে আমি একটা বই করার জায়গায় এসেছি। তারপর ওর প্রথম বই 'চেনা আনফ্রেম'। আর 'বিল্লিবাদল' তো তার পরে। এই মুহূর্তে ও যে
সিরিজটা পড়ল, তার একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। একটা রাজনৈতিক অবস্থার কথা আছে।
কিন্তু এটা খুব শাশ্বত, যে আজ মানুষ কীভাবে আছে, কীভাবে বাঁচছে, খাবার কোথায়, আর
প্রাচুর্য কোথায়। প্রাচুর্যর সাথে খাবারের যোগ নেই। প্রাচুর্য একজায়গায় আলাদা হয়ে
রয়েছে আর দুর্ভিক্ষ এক জায়গায় আলাদা হয়ে রয়েছে। এই যে ছবি, এই ছবিটাকেই ও সিরিজের
মধ্যে এনেছে। এবং শুধু এই কথাই নয়। প্রত্যাশার কথাও ও জাগিয়ে রেখেছে ওর ছবির
মধ্যে। প্রথম যে সিরিজটা ও পড়ল। আর শেষ যে কবিতাটা ও পড়ল, ওটা আলাদা একটা কবিতা।
মুগ্ধ হওয়ার মত খুব গভীর একটা লেখা। এখানে যারা আছেন তারা সবাই কবিতাকে নিজের মত
যাচাই করতে জানেন। ফলে সে ব্যাখ্যায় আমি যাচ্ছিনা। তবে 'চেনা আনফ্রেম' এ ওর যে
ভাষা, সে ভাষা আমার অতি পরিচিত। সে ভাষায় লেখা কবিতা অন্য কোথাও পেলে, নাম না
থাকলেও আমি বলে দিতে পারব যে এটা দেবাঞ্জনের লেখা। 'বিল্লিবাদল' এও সে ভাষা ছিল।
এই কবিতাতে আমার মনে হচ্ছে ও নিজের সিগনেচারকে সামান্য একটু পরিবর্তন করেছে। এটা
কতটা ঠিক বা ভুল, সেটা দেবঞ্জনই বলতে পারবে। আমি শুধু আমার মনের কথাটা বললাম।
লিখুক। ও তো লেখার প্রতি প্রতিশ্রুত, সামনে আরও লিখতে থাকুক।
উমাপদ কর
স্বপন এবার কিছু বল।
স্বপন রায়
দেবাঞ্জনের কবিতা আমি দীর্ঘদিন থেকে পড়ছি। এই কবিতাগুলো সমাজমনস্ক।
সমাজমনস্ক কবিতা ওকে ভাবনার দিক থেকে কিছুটা রক্ষণশীল করে তুলেছে,। আমার মনে হল
যে, কবি ভাবছে, আমায় কোনও না কোনও ভাবে কিছু কনভে করতে হবে। এই কনভে করার ভেতরে
যেসব প্যাকেটগুলো থাকে অনুভবের, সে প্যাকেটগুলো ও আর বেশি বিমূর্ত করেনি। এই
অবস্থানটা দেখো, এমন এক সময়ে আমরা আছি… সেটা কবিতা হওয়াটাকে হয়তো বাধা দেবে, এ
নিয়ে বিতর্ক করতেই পারি আমরা। আর যেটা মনে হলো আমার, ওর কবিতার খেলার জায়গাটা খুব
লিনিয়ার। সেই লিনিয়ারিটি ও ত্যাগ করেছে। আমি তো এভাবে বলতে পারিনা যে 'বিল্লিবাদল'
বা 'চেনা আনফ্রেম' এ ও যা ছিল, ও সেখানেই থাকবে। সেখান থেকে সরে যাওয়ার একটা চাপও
ওর মধ্যে ছিলো। এখন একেকজন কবি এটা একেকভাবে করে। আমি দীর্ঘদিন পর ওর কবিতা পড়লাম।
ইন ফ্যাক্ট দেবা আমাকে ওর নতুন কবিতা 'কবির আবাস' সিরিজটা মেইল করে ও আমাদের কথাবার্তা
হয়। এবং আমার সবসময় মনে হয় যে কনফিউশন থাকলে ভালো। সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
রাস্তা থাকে। আর একটা লোক যদি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়, তাহলে সেটা হয়না। তারা যেখানে
তৈরি হয়, সেখানে কনফিউশন থাকে। তার থেকে আরেকটা তারার জন্ম হয়। লেটস হোপ ফর দ্য
বেস্ট, দেবাঞ্জন।
চিত্তরঞ্জন হীরা
আমি বলব একটু?
উমাপদ কর
হ্যাঁ বলো।
চিত্তরঞ্জন হীরা
দীর্ঘদিন কবিতা পাঠের ফলে আমাদের একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছিল, যে সমাজ মনস্ক
কবি, আমাদের যৌবনে, যে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের কবিতাপাঠের যে অভ্যাস, বা
সমাজমনস্ক কবিতা বলতে যে একটা মেসেজ, বা একমাত্রিক কবিতা, মানুষের কথা সরাসরি বলতে
হবে, তার ফলে কবিতায় মাধুর্য বা সৌন্দর্য বা এই যে এলিমেন্টগুলো, সেগুলো আমরা
পাচ্ছিলাম না। তাতে কী হতো? মনে হতো সব কবিতা, দু চারজন কবির কবিতা ছাড়া, প্রায়
একই মনে হতো। আজকের এই পিরিয়ডে এসে, কবিরা যে সমাজমনস্কতার কথা, স্বপন দা বলছিল,
বিমুর্ততা অনেকটা কম, আলটিমেট কিন্তু বিমূর্ত শব্দটা এসেই গেল। এর মধ্যে দিয়েও,
কবিতার কাছে দায়বদ্ধ থেকেও, মানুষের কথা বলা যায়, সময়ের কথা বলা যায়, রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটের কথা বলা যায়, এটার যে নির্মাণ, সে নির্মাণ একটা নতুন ধারার জন্ম দেয়।
সেই ধারার কবিতা অনেক সুন্দর। পারফেক্ট শব্দটা তো হয়না। কিন্তু অনেক বেশি তৈরি হয়ে
ওঠা কবিতার রূপ এটা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সহজ কথা বলছে, তবে সহজ নয়। অনেকগুলো
ডাইমেনশন আছে। যেমন শ্লেষ, ব্যঙ্গ এরও রূপ বদলে গেছে। সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি,
ও তার সাথে মানুষের ভাষাপ্রযুক্তির যে বদলে যাওয়া, তার প্রতিচ্ছবি। 'চেনা আনফ্রেম'
আমি পড়েছি, 'বিল্লিবাদল' ও পড়েছি। সেই বই থেকে এই লেখার যে পরিবর্তন, তা
অবশ্যম্ভাবী ছিলো। এই অবশ্যম্ভাবী যে বাঁক, এটা পজিটিভ সাইন। আমার খুব ভালো
লেগেছে।
Post a Comment