অনুপ্রেরণায় কবিতা, কবিতার অনুপ্রেরণা
পার্থসারথি ভৌমিক
রৌদ্রকরোজ্জ্বল পুবে আকাশ ফুটে উঠলো। এক থেকে ক্রমান্বয়ে পাখি-ওড়া শুরু হলো অনন্তের দিকে। খোঁজ। দিনের তারা থেকে নিষ্ক্রান্ত সমান্তরাল আলোকরশ্মিরা- অনুপ্রেরণা। অনন্তের দিকে ‘খোঁজ’ হলো সৃজন প্রক্রিয়ার একটি মৌলিক ধাপ। এক্ষেত্রে কবিতার গড়ে ওঠার আভাস। নীল শঙ্কুর নিলীমায় বাঁধা পড়া সতোৎসারিত চেতনাবিন্দু- কবিতার জন্মলগ্ন।
অনুপ্রেরণায় কবিতা আর কবিতার অনুপ্রেরণা । যা খুশি বলোনা ওটা ম্যাটার
করেনা। প্রেরণা শব্দটা হচ্ছে উৎসাহ প্রদানের খুব কাছাকাছি।
প্রানিক স্তর থেকে যে উৎসাহ, সেটাই প্রেরণা। তার আগে একটা শব্দ রয়েছে,
সেটাকে শব্দ নয় উপসর্গ বলতে হবে- অনু। একটা শব্দের আগে যখন একটা উপসর্গ বসে তখন
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থটা কিন্তু বদলে যায়। যেমন একটা শব্দ সরণ। সরণ হচ্ছে, একটা বিন্দু
থেকে যাত্রার শুরু করে যেখানে শেষ করা হল তার একটা রৈখিক পরিমাপ। কিন্তু যখনই
সরণের আগে অনু বসাচ্ছি সেটা হয়ে যাচ্ছে অনুসরণ। পিছু পিছু যাত্রা করা। সুতরাং
উপসর্গ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগে বসে শব্দের অর্থটাকে বদলে
দেয়। কিন্তু আজকের এই সাবজেক্টে আমি প্রেরণা আর অনুপ্রেরণার মধ্যে পার্থক্য টানতে
মুশকিলে পড়ছি। দুটোই, অনুপ্রারণ- এই শব্দের কাছাকাছি। একটা শক্তি সঞ্চার করা।
অবশ্যই, অনুপ্রেরণা মানে সে একটা শক্তির সঞ্চারণ। কিভাবে?
রৌদ্রকরোজ্জ্বল- রৌদ্রের রশ্মিতে প্রতিভাত, ওপরে যেভাবে পুবের নির্দিষ্টকরণ
হয়েছে।
কিন্ত অপর
অর্থে যদি রৌদ্রের দুটি হাত পরস্পর কৌণিক ভাবে মেলে, আর
উজ্জ্বল, পবিত্র অক্ষরের মতো প্রতিটা ওড়া– পাখির ওই কোণে নিরন্তর ও
ধারাবাহিক সমাপতন ঘটে চলে, বিমূর্ত থেকে মূর্ত হয় রেহেল। নতুনতর, তরুণতর , কবিতার দল পুষ্পিত দেখি।
এই ‘দেখা’ মূলত
মস্তিষ্কের নির্দেশে চোখ দ্বারা সম্পাদিত হয়। চোখের আলোকসংবেদী অংশ রেটিনা, আলোকরশ্মিকে
তড়িৎ-সংকেতে রূপান্তরিত করে দর্শনের অনুভুতি, স্নায়ুর
মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায় ।
‘দেখা’, নিছক অবলোকন থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে চেতনাশ্রয়ী উপলব্ধি পর্যন্ত যে কোন স্তরেই কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা হতে পারে। এবং যে কোন বস্তু অথবা
প্রাণ-কে চেতনার আলোকে সম্পর্কিত করতে বাকি ইন্দ্রিয়গুলির পৃথক ও সম্মিলিত ভূমিকা
দর্শনেন্দ্রিয়েরই অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ। তবে
ইন্দ্রিয়সকল প্রারম্ভিক যোগসূত্র হিসেবে ভূমিকা নিলেও একটি পর্যায়ের পর
ইন্দ্রিয়াতীত সংযোগই কবির অভীপ্সিত থাকে ।
কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন 'কবিতার মুহূর্ত'। কবিতা যখন লেখা হচ্ছে, সেই
কবিতাটাকে সৃষ্টি করছেন কবি এবং একটা চেতনা। একটা স্পার্ক দিয়ে কবিতার জন্ম হচ্ছে।
এই স্পার্ক কে কি আমরা অনুপ্রেরণা বলতে পারিনা? এবার প্রশ্ন হল, কবি কী থেকে
অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন সেই কবিতাটি লেখার জন্য?
কবির নিজের চরিত্র, তার অন্তর, তার চেতনাই হচ্ছে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা।
কবিতা এমন একটা শিল্প যে, বাইরে থেকে কেউ অনুপ্রেরণা নিয়ে কবিতা লিখে ফেলবে, সেটা
সরাসরি সম্ভব নয়। সেটা কবির অন্তরেই থাকে। কেউ হয়তো খুঁজে পেতে পারেন কোনও একটা
অ্যাসোসিয়েশন, যে অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে আসাতে কবিতা লেখার মুহূর্তটি এসেছে। কিন্তু
কবিতা লেখার মতো সমস্ত এলিমেন্ট তার নিজের মধ্যে আগে থেকেই ছিল, তাইতো ওই
অ্যাসোসিয়েশনটা সেটা তাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। যদি সেই এলিমেন্টস্ গুলো না থাকে, যদি সেই চার্জ না
থাকে যেটা থেকে সে লেখা শুরু করবে তাহলে? তাহলেও কি কবিতা লেখা সম্ভব হবে?
চেতনা দিয়ে বস্তুপ্রাণ গ্রাহ্য
হওয়াই কবিতার যুগপৎ মৃত্যু ও জন্মের লগ্ন বল বিবেচনা করা যায়। কেননা
কবির ‘অলিখিত’ কিংবা ‘অনুচ্চারিত’
গ্রাহ্যতা, যোগাযোগরহিত হলে মুহূর্তের
মধ্যে তা বিলীন হয়ে যায়। অন্য
ক্ষেত্রে তা লিখিত বা উচ্চারিত হলে, উন্মেষিত
বোধটির অনুসৃষ্টিই কেবল হওয়া সম্ভব যদিও আমরা সেটাকেই
প্রসঙ্গে ‘মূল
কবিতা’ হিসেবে ধরে নিই। কারণ, এক্ষেত্রে স্রষ্টা তার অন্তরলীন
একটি সৃষ্টির অনুকরণে অপর সৃষ্টিটি করে থাকেন। কবিতা
এমনই উপায়হীনভাবে সংজ্ঞায়িত হোক ।
চরম কোন শক্তির সাথে অতীন্দ্রিয়যোগ, কবিশিল্পীকে তার সৃষ্টির
উৎকর্ষতায় সাধারণের থেকে পৃথক বলে নির্দেশ করে। তার
সূক্ষতম আত্মজিজ্ঞাসার পথে এই মহাবিশ্বের সকল বস্তু ও প্রাণের সাথে চেতনার পরিসরে
পৃথক পৃথক সম্পর্কের দ্যোতনা, কবিতাখণ্ড হয়ে
চিহ্ন রেখে যায়।
কবিতায়, কবির যাপনলিপি চিত্রিত হয় আপন
রেখারঙের উৎসার দিয়ে। পারিপার্শ্বিক ঘটনা কবির মনে প্রক্ষোভ আনে, রূপ খোলে বোধের মুকুর। পরবর্তী পর্যায়ে
ওই মুকুরের অনূদিতলিপি হিসেবে কবিতা পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে।
প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি যে কোন প্রেক্ষাপট থেকেই কবি, কবিতা
লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে
বিষয়টি তার চেতনার যে কোন একটি স্তরে অভিঘাত আনতে পারলো কিনা, সেটাই কবিতাভাবনার মূল শর্ত হিসেবে কাজ করে থাকে। বিষয়ের আত্তীকরণ, কবিমানসের
স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, যার অভিভাব
কবিতায় সাংকেতিক রূপে দেখা দেয় ।
অন্য কোন পূর্বসূরি কবির সৃজন, উত্তরসূরি কবিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। কবিতা ব্যতীত অন্য যে কোন শিল্প
থেকেও, কবিতা সৃষ্টির উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় ।
একটা মানুষ যখন যে কোনও একটা কাজ করে তখন কাজের ভেতরেও আর একটা কাজ থাকে। কবিতা লেখাটুকু বাদেও তো একটা জীবন থাকে মানুষের, কর্মজীবন, সাংসারিক জীবন, সমাজ জীবন, অনেকগুলো জীবন থাকে। সেই জীবনগুলোর মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যে মানুষটা কবিতা লেখে সেই জীবনের রং রস কবিতার মধ্যেও খেলা করে। যে মানুষটা কবিতা লেখে সে দৈনন্দিন অনান্য সকল কাজের ফাঁকে কমবেশি কবিতা যাপন করে। তার জার্নিটা হচ্ছে একটা জার্নির ভেতর জার্নি। যেমন রেলগাড়ি ছুটছে আমরা ভেতরে বসে আছি। আপাতভাবে বসে আছি কিন্তু আসলে যাচ্ছি। নাকি আপাতভাবে যাচ্ছি, আসলে বসেই আছি?
Post a Comment