Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।


রোয়াকে
কবিতা পড়লেন সজল দাস
আলোচনা করলেন মনোজ দে, চিত্তরঞ্জন হীরা

সূত্র ধরলেন উমাপদ কর

আমরা এই সেশনটা শেষ করব আর একজন কবিকে দিয়ে। সে হচ্ছে সজল দাস। বাদবাকি যারা থাকলো, তারা কাল রাত্রের শেষ সেশনে কবিতা পড়বে।

সজল আর জয়দীপ, ওদের সাথে আমার আলাপ, যখন সমীরণ 'কথামুখ' করছিলো তখন থেকে। প্রায় সবাই কবিতা পড়ে যাওয়ার পর, একটা আহ্বান জানানো হয়েছিলো, আর কেউ যদি কবিতা পড়তে চান, তাহলে এসে আপনি পড়ুন। জয়দীপ প্রায় ঠেলে সজলকে মঞ্চে তুলে দিলো। চার পাঁচ লাইনের প্রায় গোটা তিন চারেক কবিতা ও পড়লো। বারীন ঘোষাল বসেছিলো। তার আগে জয়দীপ পড়েছে। ও 'ছাদ' বলে একটা কবিতা পড়েছিল। আমি মঞ্চে একটু হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকদিন আগের কথা। ওর যে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, আমি অতটা জানতাম না। ভেবেছিলাম, একটা ওইটুকু ছেলে এইভাবে ভাবতে পারে, এই ব্যাপারটা আমাকে স্রেফ চমকে দিয়েছে। একটা মানুষ ওইভাবে ভাবতে পারে! অনুষ্ঠান শেষে বারীনদার সাথে আমরা বসলাম। জয়দীপ এবং সজলকে চিহ্নিত করল বারীনদা। বললো এদের কবিতা আমাকে অভিভূত করেছে। তোরা এদের সঙ্গে টাচ রাখবি। তার আগেই অবশ্য জয়দীপের সাথে আমার আলাপ। একটা অনুষ্ঠানে ওর কবিতাপাঠ শুনে ওকে ডেকে নিয়ে এসে ওর সাথে আমি আলাপ করেছিলাম। সেই সজল পরবর্তীকালে কবিতা লিখতেই থাকে, লেখে। ওর বই হয়। চিরকালই ছোট লেখে ও। ওই চার- পাঁচ লাইনের। কখনও সাড়ে ছ লাইন। এভাবেই ও লেখে। কীভাবে লেখে সে ব্যাখ্যায় আমি যাচ্ছি না, কারণ ও এখুনি কবিতা পড়বে। রিসেন্টলি ওর আরও একটা বই বেরিয়েছে। আমার বাড়িতে যে সিটিং হয়েছে গত পাঁচ ছ বছরে, তার অনেকগুলোতেই সজল ছিলো। ওর সাথে, ওদের সবার সাথে আমার প্রচুর ইন্টারাকশন হয়েছে। সজল কবিতা পড়ার পর, আমি আজ আর কিছু বলব না। যারা সামনে বসে সজলকে শুনছে আজ, তাদের মধ্যে একজন তরুণ কবি ও একজন সিনিয়র কবিকে দিয়ে আজ আমি বলাবো।আমি নিজে আর কিছু বলছি না, শুধু সজল কে আমি মাঝে মাঝেই চেতাবনি দিই, ও শোনে না, ভালো।

কেন সে আরেকটা লোকের দ্বারা, কথার দ্বারা প্রভাবিত হবে, অপরজনেও লিখেছি। বছর দেড়েক আগে ওকে বলেছিলাম যে তুই খুব সেফ জোনে খেলছিস। এটা কবির নির্বাচন, যে সে কোন পথে যাবে, কী লিখবে, তাতে আমার বক্তব্য নেই কোনও। কিন্তু ভাবনার দিক থেকে এত সূক্ষতার জায়গায় থাকা একজন মানুষ , এত সম্ভাবনাময় একজন কবি, তার কাছে তো প্রত্যাশা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এটুকুই বললাম আমি। বাকিটা সজল পড়ুক। আমি পরে বলে দেব ওর কবিতা নিয়ে কে কে বলবে।

 

সজল দাসের কবিতা

ছুরি-১

অহেতুক যে ছুরি

এতদিন ঘষে ঘষে কাটলে

জানলে না একফোঁটা চুনই তা পারতো

 

দুধ আসলে তখন আমাদের অনুতাপ

 

ছুরি-২

একটা রক্তাক্ত ছুরির

দুদিকে সমান পা ফেলে হাঁটছ

 

যেমন ঘোড়া ও বরফ

কেউ কারো জন্য উপযুক্ত নয়

 

 

ছুরি-৩

বিচ্ছিন্ন আর উদাস হওয়ার পর

ফল গাছকে ভুলে গেল

 

পাতা যে একটি রান্নাঘর সে কথাও উপেক্ষা করল তখন

 

ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়লো নদীর দিকে

 

শুধু বাবা এলে মনে পড়ে

হাওয়া কীভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল সম্ভাবনার বীজ

 

*

 

সমুদ্র দূরে রেখে

যে হেঁটে গেছে ঝাউবনের দিকে

সে ঢেউয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী

 

আর কাঠের অনন্ত নিঃশ্বাসে

ভেঙে ফেলেছে গতজন্মের আলনা

*

 

শিশুর পাশে খেলনা ঘোড়া রেখে

চলে গেছে মা

 

খোঁড়া শিশুর পাশে

ঘুমন্ত খেলনা রেখে চলে গেছে

 

কাঠ খোঁড়া

কেননা গাছ হাঁটতে পারেনা

 

*

তারা খসে গেলে

রাত্রি অবুঝ ও একা হয়ে যায়

 

খাবার খায়না

অহেতুক বাইরে যাওয়ার বায়না করে

 

বরফ শুধু বরফের সামনেই ওকে শান্ত দেখায় তখন

শুকনো আর কালো দেখায়

*

 

পাহাড় পেরিয়ে আসা মানুষ 

দুঃখের গাছের কাছে নত হয়

 

পাথর ক্লান্ত

তাই কান্না ভাঙতে পারলো না

 

শিকার ধারালো হলে মানুষ এমনিই অস্ত্র

অথচ রক্ত তেমন শক্ত নয়

 

দুঃখের পাহাড় পেরোনো মানুষ

রাত্রির গাছের ভেতর দিয়ে

একা একা আকাশে চলে যায়

*

 

যে মাছ মৃত

বরফকে সে সন্দেহ করেছিল

 

আর নৌকো দেখে ভেবেছিল জলের দেবতা

 

ধরা পড়ার আগে

মাঝি এসব বলছিল খিদের বাঘকে

*

 

আঘাত আর ঢেউ আমি এভাবে দেখলাম

যেন তোমার চোখের বালি

সারাতে এসেছে জল

 

গাছের চিৎকার কেউ শোনেনি

শুধু আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে যায় আকাশের দিকে

*

 

ফল পড়ে যায়

কারণ মানুষ ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে

 

বৃষ্টির পর সব রাস্তাই সহজ মনে হয়

 

বরফের কাছে চাইতে গিয়েছিল

জল তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে

 

জলের দোষ নয়

বালিরও নয়

 

নৌকো এমনিই পড়ে আছে 

*

 

তুলোগাছের নিচেই তোমার বাড়ি

দ্যাখো মানুষ পাথর নিয়ে বাড়ি ফিরছে

 

আঘাতে বানানো বাড়ি

পাথরের দরজা দিয়ে বন্ধ

 

শিকলের শব্দ হয়

জল ভারি বলে তুলোর এত কষ্ট

 

বালিশের দাগ নদীর চোখের চেয়ে আবছা

 

আরও নীল তাকেই আকাশ ডাকো

আর ছিঁড়ে ছড়িয়ে রাখো রাস্তায়

 

তুলোগাছের নিচেই তোমার বাড়ি

তাই দুঃখ নেই

 

বালিশ বানানোর ব্যবসায় তুমি বীজ বাছাই করো

*

 

উমাপদ কর

মনোজ বলো

 

মনোজ দে

এই লেখাগুলো নিয়ে বলার আগে সজলদার লেখা নিয়ে কয়েকটা কথা আমি বলে নিতে চাই। সজলদার লেখা আমি সজলদার প্রথম বই বেরোনোর আগে থেকেই পড়েছি। এবং আমার অসম্ভব ভালো লাগে। আমার মনে হয় প্রথম দশকে যদি গুটিকয়েক কবিকে লেখা দিয়ে আলাদা করা যায়, সজলদা তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে 'কৃত্তিবাসে' যে লেখাটা বেরিয়েছিল, 'ছড় টানতে টানতে বেহালা হয়ে উঠলো যে বাদক' ... বা 'দিদিমা' কবিতাটি, মানে, এই লেখাগুলো পড়লে চুপ করে যেতে হয়। আজ যেমন লেখাটা পড়ল দাবানল নিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হলো কীভাবে সেই দাবানল আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটা। আমার মনে হয়, সজলদার লেখা এরকম, যেন একটা কনসেপ্টকে, মানে, কবিতা তো অ্যাবস্ট্রাকশানের দিকে নিয়ে যায়, যেমন ধরা যাক বাড়ি, এই বাড়ি ভাবনাটাকে আমরা কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি কবিতায়, সজলদার মজাটা এই জায়গায়,যে একটা ভাবনাকে, সে হয়ত নাম বলছে না যে দাবানল, বা সরাসরি প্রতিশোধের কথা বলছে না, অথচ ভাবনাটা, এবং তার শৈলী, শেষ পর্যন্ত এই জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যে ওই অ্যাবস্ট্রাকশানের চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে এবং পাঠককে চুপ করিয়ে রাখে। যে কীভাবে লিখছে বা ভাবছে কোনও এক ঘটনাকে, যেমন বালি, জল সারাতে এসেছে, যে কথাটা আমি বলতে চাইছি না তা , অন্য মেটাফর দিয়ে, অথচ পাঠককে একবারও ভাবতে হচ্ছেনা এটা অন্য ঘটনা। সে রিলেট করছে। এবং তাকে চুপ করিয়ে রাখছে। একজন কবির ভাবনা কতদূর বিস্তৃত হলে সে এরকম বিষয়গুলোকে রিলেট করিয়ে ভাবনাকে বহুস্তরীয় করতে পারে। সজলদার লেখা এই কারণেই ভালো লাগে এবং যতবারই পড়ি, বারবার পড়তে মন চায়।

 

উমাপদ কর

চিত্ত বলো

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

সজলের লেখা শুনতে শুনতে আমার অনেক কিছুই মনে পড়ল এবং নিজেকে আমি নিজে ক্রস করলাম। হঠাৎ আমার সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ছিলো। সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আমি বলব, ওর কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এবং সেটাকেও সজল (দাস) কীভাবে পেরিয়ে এসেছে। আসলে আমি এলিমেন্ট খুঁজছিলাম। একটা এলিমেন্ট,  জীবনানন্দ পরবর্তী বাঙলা কবিতায় যে প্রবণতাগুলো দিয়ে আলাদা হয়ে এসেছে, তার একটা এলিমেন্ট হলো, যুক্তি পরম্পরা ও সিদ্ধান্তকে কেমন করে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু কবিতার মধ্যে একটা বড় পরিসর তৈরি হয়ে রয়েছে। আপাতভাবে মনে হবে, কবিতার এই লাইনটার সাথে ওই লাইনটার কোনও রিলেশন নেই। কিন্তু পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করায়, যে অনেকটা পরিসর তৈরি করেও একটা রিলেশন তৈরি করে রেখেছে। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এই কবিতাগুলো একবার শুনে এই কবিতা থেকে বেরোনোর জায়গা নেই। ওর কবিতা আক্রান্ত করে। তন্ময়ের কবিতা যেমন, আক্রান্ত করে। একটা ঘোর। ওর কবিতাও তেমন। মনোজ যেমন বলল, চুপ করিয়ে রাখে। আমাকে আবার ওর লেখা পড়তে হবে। সজল (দাস) কোথায় পেরিয়ে এসেছে শ্রুতির কবিদের। একটা কবিতা আমি পড়ি, এই একটা কবিতাই আমার জীবনে আমি মুখস্থ রাখতে পেরেছি। আমার নিজের একটি লাইনও আমার মনে নেই। পৃথিবীর কোনও কবির কোনও লাইন আমার মনে থাকেনা। শুধু সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কবিতাই আমার মনে গেঁথে আছে।

 

১৫ আগস্ট ১৯৮০

 

লোকটার অপরাধ

ছাদে ওড়া পতাকা চুরি করেছে

 

লোকটার অপরাধ

ছেলেটার জামা বানিয়েছে

 

বিচারে

লোকটার কোনও

স্বাধীনতা থাকছে না

 

এই কবিতা থেকে আরও কতদূর নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সহজ শব্দে সহজ কথায়, সজল (দাস) তার দৃষ্টান্ত। এটা আমার মনে হয়েছে ভীষণভাবে।



Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger