Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।


রোয়াক অবসরে কবিতা বিষয়ক গদ্য

সুর আর কথার বিবাহ এবং বিচ্ছেদ

স্বপন রায়

 

গান হল কথা আর সুরের বিবাহ। এমনটাই বলতেন রবীন্দ্রনাথ।তার আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুর শাসন করত কথাকে।তাহলে বৈষ্ণব পদাবলী বা রামপ্রসাদের গানগুলোকে সময়ের নিরিখে বিবাহিত বলতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ যদিও আধুনিক বাংলা গানের নতুন ‘জঁর’ সৃষ্টি করার আকুতি থেকেই একথা বলেছিলেন।পরে যা রবিবাবুর গান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে পর্যবসিত হয়।আমি সঙ্গীত বিশারদ নই, রেহেলের সম্পাদকমণ্ডলী আমায় তবুও এই দায়িত্ব দিল, হায় আমিও নিলাম! গান আর কবিতা নিয়ে আমার বুক্‌নি বকুনিতে আর আমার যাবতীয় বুলি ‘বুলিং’-এ পর্যবসিত হবে এটা জেনেই।


প্রথমে ‘গল্লি’ কাসিম জান, বাল্লিমারান, পুরনো দিল্লির  গালিববাবু অর্থাৎ মহাজন মীর্জা আসাদুল্লা বেগ খান ওরফে গালিবের একটা ‘শের’-এর আড়ালে থেকে শুরু করি। বাঙালির ঢাক অতি প্রিয়, ঢালও কিন্তু অপ্রিয় নয়।আর গালিবের মুঘলাই আমলের এই নান্দনিক ঢালটিতো অপ্রতিরোধ্যঃ

‘হাজারোঁ খ্বোয়াইশেঁ এইসি কি হর খ্বোয়াইশ পে দম নিকলে

বহত নিকলে মেরে আরমাঁ লেকিন ফির ভি কম নিকলে’

(হাজারো ইচ্ছে এমনই ইচ্ছে, যে প্রতিটি ইচ্ছে ফুরিয়ে দেয়

 অনেক তো হল ইচ্ছে প্রকাশ, মনে হয় তবু হলনা কিছুই)

 

তো ইচ্ছে আমার এই লেখায় গান আর কবিতাকে উন্মোচিত করার, তবে এও তো জানি যাই লিখিনা কেন, কম হবে। হাস্যকরভাবে কমই হবে।


কথন, গায়ন এবং লিখনের উৎসে রয়েছে ধ্বনি। ভাষারও। ধ্বনির মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু হয় প্রায় আশি লক্ষ বছর আগে, আফ্রিকায়। বনমানুষ এবং শিম্পাঞ্জী গোত্রের প্রাণীরা পারস্পরিক সংযোগের জন্য ধ্বনির ব্যবহার করতে শুরু করে। ভাবুন, সেই আদি ধ্বনিময় আমাদের এই দুনিয়া, আমাদের সেই জায়মান দুনিয়ায় তখনই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আজকের গান আর কবিতার বীজগুলো। পরম্পরার বয়স তাই এক তমসাদীর্ণ আলোর বয়েসি যার মাপ আর নেওয়া যাবেনা।এরপরে আনুমানিক ২০ লক্ষ বছর আগে বর্তমান মানুষ বা ‘হোমো সেপিয়েনদের’ পূর্বপুরুষ নিজেদের বনমানুষ এবং শিপাঞ্জীদের থেকে আলাদা করে নেয়। এদের যোগাযোগের ভাষা যদিও বনমানুষ এবং শিম্পাঞ্জীদের থেকে উন্নত ছিল কিন্তু তাদের ভাষিক উচ্চারণবিধি সম্পর্কে এখনো অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। গান আর কবিতার সৃষ্টিই হতনা যদিনা আমাদের আদি পূর্বজরা ‘সাইন ল্যাংগুয়েজ’ থেকে ‘সাউণ্ড’ বা শব্দ  আবিষ্কার করতেন, তবে এসবই ছিল একটি বিশাল প্রক্রিয়ার অংশমাত্র। এই পর্বে মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ সততই সৃজনশীল ছিল এবং এখনো রয়েছে। তবে নান্দনিক উৎসারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো প্রায় ১৯ লক্ষ বছরেরও বেশি। এতটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে আনুমানিক ৬০০০০ থেকে ৩০০০০ বছর আগে মানবসমাজের মধ্যে এক নান্দনিক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। শুরু হয় গুহা মানবদের অঙ্কনশিল্প, অঙ্গসজ্জার জন্য অলঙ্কার বানানো, মৃতদেহ কবর দেয়ার সংস্কার ইত্যাদি। সঙ্গীতের জন্মও এই সময়েই হয়েছে বলে মনে করা হয় কারণ উন্নত মানুষের অনুভব, আবেগ, বিনোদ, শোকপ্রকাশ ইত্যাদির জন্য লোকায়ত শব্দাবলীর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সঙ্গীতের সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৯৫ সালে স্লোভেনিয়ায় আবিষ্কৃত প্রায় ৬০০০০ বছরের পুরনো একটি ভাল্লুকের ফিমার বোন দিয়ে বানানো বাঁশিকে সব চেয়ে পুরনো মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট বলা হলেও নিয়ান্ডার্থাল মানুষরা বাঁশির মত সুক্ষ্ম বস্তু ব্যবহারের যোগ্য ছিলনা বলেই অনেকের ধারণা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে শকুনের ডানার হাড় দিয়ে বানানো ‘ভি শেপ’-এর ৪৩০০০ বছর আগেকার একটি বাঁশিকেই সবচেয়ে পুরনো সাঙ্গীতিক যন্ত্রানুসঙ্গ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে এখন। যাইহোক সুর তো এল, কথা কিন্তু তখনো আসেনি। কথা এল আরো অনেক অনেক হাজার বছর পরে।১৪০০ খৃঃপূঃ রচিত ‘ hurrian hymn no.6’ (https://youtu.be/QpxN2VXPMLc) কে সবচেয়ে পুরনো মিউজিকাল ‘নোট’ হিসেবে গন্য করা হয়। এই ‘নোট’টি ১৯৫০ সালে সিরিয়ায় প্রাপ্ত হয়েছিল।অন্যদিকে বেদ, যা ১৫০০ খৃঃপূঃ-এর সৃষ্টি বলে ধরা হয় তা মূলত ছিল শ্রুতি নির্ভর। বেদের লিখিত রূপ পাওয়া যায় ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্টে। যা ২৩২ খৃ পূ’র সমসাময়িক, তবে শ্রুতি নির্ভর বেদের উৎস প্রায় ৩৫০০ বছর আগে বলে ধরা হয়, লিখিত প্রমাণ কিন্তু নেই। বেদ ওই সময়কার এক দার্শনিক দলিলও বটে। যেখানে বলা হয়েছে শব্দ থেকেই এই জগৎ সৃষ্ট হয়েছে। তবে সব শব্দকেই বেদ বলা যায় না । ছন্দময় শব্দই বেদ । বেদে প্রধানতঃ  ‘মন্ত্র’ আর ‘ব্রাহ্মণ’ এই দুটো ভাগে বিভক্ত । বেদ গদ্য আর পদ্যের সমাহার। বৈদিক গদ্যগুলোর নাম ‘ব্রাহ্মণ’ বা ‘নিগদ’, বৈদিক পদ্যগুলোর নাম ‘ঋক্’ বা ‘মন্ত্র’ । আমরা জানি যে, বৈদিক মন্ত্রের ছন্দ প্রধানত সাতটিঃ গায়ত্রী, উঞ্চিক, অনুষ্টভ, বৃহতী, পঙক্তি, ত্ৰিষ্টভ ও জগতী। গায়ত্ৰী ছন্দ ত্রিপদী। এক এক চরণে আটটি করে অক্ষর বা ২৪ অক্ষরের সমষ্টি হল গায়ত্রী ছন্দ । গায়ত্রীর ছন্দের ২৪ অক্ষরের সঙ্গে আরো ৪টি অক্ষর যোগ করলেই পাওয়া যাবে উঞ্চিক ছন্দ। এবার চারটি করে অক্ষর যোগ করে গেলে অন্যান্য ছন্দগুলির গঠনশৈলী পাওয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে বেদের ঋক বা মন্ত্রগুলি ছন্দের স্ট্রাকচার বা গঠনে উচ্চারিত হত এবং এই উচ্চারণে সুর থাকতো বৈচিত্র আনার জন্য। এসব বলা এজন্য  যে গান আর কবিতার সম্মেলন প্রথম যুগেই চলে এসেছিল একটি নিয়মশাসিত গঠনশৈলী বা স্ট্রাকচার। যা পরবর্তী সময়কে শাসন করবে সুদীর্ঘ সময় ধরে।

“He who saw all, who was the foundation of the land,

"Who knew (everything), was wise in all matters.

"Gilgamesh, who saw all, who was the foundation of the land,

"Who knew (everything), was wise in all matters."


এবার কবিতাকে দেখা যাক। ফিরে দেখা, কবিতা নাম যখন ফিরে দেখতেই হয়! উপরের উদ্ধৃত অংশটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো লিপিত কবিতার প্রথম চারটি পংক্তি।সুদীর্ঘ এই ‘মেসোপোটেমিয়ান এপিক’-এর বয়স চার হাজার বছর, নাম ‘এপিক অফ গিলগামেশ’ যেখানে সম্ভবত ‘নোয়া’ এবং সেই ভয়াল বন্যার কাহিনি লেখা হয়েছে।১৫০০০ হাজার শব্দের এই মেসোপটিয়ান এপিকটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে।তাহলে ধ্বনি, সুর, গান হয়ে লিপিত কবিতায় পৌঁছতে হাজার হাজার বছর লেগে গেল, আমাদের কবি এই হাজার হাজার বছরের তিতিক্ষাকেই হয়ত তিল মাত্র করে লিখেছিলেনঃ

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।‘ ( বনলতা সেন/জীবনানন্দ দাশ)


এটা কোনও তুলনামূলক কবিতাভ্রমণের ব্যাপার নয়, গান থেকে কবিতায় যাওয়া যেন এক প্রেমিকের ‘বনলতা সেন’কে খোঁজার মতই একনিষ্ঠ সাধনা, বিলম্বটুকু বিরহ ভাবা যাক। কারণ গান আর কবিতার মিশ্রণে যে কবিতার গঠন গড়ে উঠল যাকে পদ্য বলাই সংগত তার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার তাগিদেই আরো কয়েক হাজার বছর পরে গড়ে উঠেছিল ‘সুররিয়াল’, ‘পোস্ট স্ট্রাকচারাল’ বা ‘অ্যান্টি পোয়েট্রি’র মত কবিতাভাবনা, আন্দোলন এবং লিখনশৈলী। আর এই যাত্রাটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা। মাত্রা, কবিতা আর গানের ফ্রেম বা সীমানা বেঁধে দিত। তবে একটা সময়ে মূলত গ্রিক সাহিত্যে এখনকার ‘মিটার’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।বাংলায় সবচেয়ে প্রাচীন লিপিত গীতিকাব্য হল ‘চর্যাপদ’, উল্লেখ করলাম, বাহুল্য জেনেও। চর্যাপদের গানগুলো বাংলা কাব্যধারার প্রথম রূপ। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী এমনকি তার পরেও চর্যাপদ রচিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য নয়। তাই সময়কাল অবধি ইতিহাস থাক। কিন্তু এই গীতিকাব্যগুলির ভাষা, যাকে আলো আঁধারির বা সান্ধ্য ভাষা বলা হয়, সেই ভাষার লিপিত প্রকাশে কেন এত গোপনীয়তা ছিল একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক।


‘চর্যাপদ বাংলাভাষার সেই অভিজ্ঞান, যা গোপনে একটি নিজস্ব পরিসর গড়ে তুলে সৃষ্টি করেছিলো বাংলা কবিতার ভুবন নিজেরই অজান্তে। অজান্তে এই কারণে যে, যে বৌদ্ধ-তন্ত্র কায়াবাদী সাধকেরা এই পদগুলির নির্মাতা, তারা কিন্তু সচেতনভাবে কবিতা লিখতে চাননি, তারা চেয়েছিলেন তাদের প্রান্তিক ধর্মকে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের ঘেরাটোপ থেকে বাঁচিয়ে সুরক্ষিত করতে। কিন্তু এই কাজ তো সহজ নয়। তাহলে উপায়? উপায় গড়ে দিলো এমন এক নব্যআবিষ্কৃত ভাষা যার সঙ্গে সমাজে মূলস্রোতে বসবাসকারী মানুষদের তেমন সংস্পর্শ তৈরি হয়নি। লোকে বলতো প্রাকৃতজনের ভাষা। উচ্চবর্ণের মানুষের যে ভাষার প্রতি ছিলো ভীষণ উপেক্ষা। পাল-সেনযুগের রাজাদের ক্রূরচক্ষু এড়িয়ে এইসমস্ত সিদ্ধাচার্যদের ওই গোপন ভাষাকেই করতে হয়েছিল ঈষৎ দুর্বোধ্য, যাকে পরবর্তী সময়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখেরা মেনে নেবেন আলো-আঁধারির ভাষা বলে, কেননা  এই ভাষার খানিক বোঝা যায়, খানিক যায় না। সেই সন্ধ্যাভাষার হাত ধরেই বাংলাভাষার প্রথম আত্মপ্রকাশ।


সমাজজীবনের  বিভিন্ন পর্যায়কে ছুঁয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও ভূগোল উঠে এল চর্যার পদগুলিতে। অনেক সময় পেরিয়ে চর্যার যে বিশেষত্বটি গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবে আধুনিক পাঠকদের কাছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে এই প্রয়াস কোনও সচেতন কাব্যপ্রয়াস না হয়েও শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলো বাংলা কবিতার আদিতম দৃষ্টান্ত, এবং বাংলা কবিতার যে আদিরূপ ধারণ করেছিলো কীর্তন, তাই সম্প্রসারিত হলো চর্যাগানে। আমরা একটু পিছিয়ে গেলাম। অথচ এই পদগুলি কী নির্জনে কী নিরাপত্তাহীনতায় রচিত হয়েছিল, রচিত হয়েছিল প্রকাশের বিপরীতে নিজেকে সংগুপ্ত রাখবার অভিপ্রায় নিয়ে। প্রকাশই যদি কবিত্ব হয়, তাহলে বলতে হয় চর্যার এই প্রকাশ ঘটেছিলো কোনও দরিদ্র কুটিরে কিংবা কোনও নিভৃত নদীর তীরে। যেখানে সমাজের এলিটদের নজর পড়েনা, কিংবা পড়লেও তারা এসব পাগলের প্রলাপ ভেবে সংক্ষেপে উড়িয়ে দেন। আর যত উপেক্ষা বাড়ে, ততই যেন নির্জনতার গহনে সৃষ্টি হয়ে চলে এই চর্যাগান আত্মপ্রকাশের পরোয়া না করে। ভবিষ্যতের বাংলা কবিতার মধ্যে যে কূটত্ব যে রহস্যর পরত অবশ্যম্ভাবী অংশ হয়ে উঠবে, তার আভাস চর্যার পুথিতেই পাওয়া যায়।’ (আধুনিক বাংলার অনুলিখনঃ রাজদীপ রায়)


বাংলা গানের মধ্যে নিহিত কবিতায় এভাবেই ঢূকে পড়েছিল প্রান্তিক মানুষের ভাষা। চিন্তা ভাবনার ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার তাগিদেই গড়ে উঠেছিল এই সাঙ্গীতিক পদগুলি। সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় কিন্তু ভেঙে পড়ল শুদ্ধতার ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রকাশ এবং তার গঠনসৌকর্যঃ

নগরবাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ্ন সো ব্রাম্হনাড়িআ॥ ধ্রু
আলো ডোম্বী তোএ সম করিব ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ॥ ধ্রু
এক সো পদমা চৌষটঠী পাখুরী॥
তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥ ধ্রু
হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে॥
আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ। ধ্রু
তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া॥ ধ্রু
তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী॥ ধ্রু
সরবর ভাঞ্জীঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ।
মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ॥ ধ্রু

পুথিপৃষ্ঠা ১৬ / কাহ্নপাদ
রাগ দেশাখ

১,২ : নগরের বাইরে ডোম্বী তোর কুঁড়েঘর,ছুয়ে ছুয়ে যাস সেই ব্রাম্হণবালককে।
৩,৪ : ওলো ডোমনী, আমি তোর সঙ্গে সাঙ্গা করবো। আমি ঘৃণাহীন এক নগ্ন,কাপালিক যোগী।
৫,৬ : এক সে পদ্ম, ৬৪ পাপড়ি,তাতে চড়ে নাচে ডোমনী ও বহুরূপী (কাহ্ন)।
৭,৮ : তোকে সদভাবে জিজ্ঞেস করি, তুই আসিস কার নায়ে?
৯,১০ : তুই না তাঁত আর চাঙারি বিক্রি করিস,তোর জন্যে আমি নটের ঝাঁপি ট্যাগ করলাম।
১১,১২ : তুই ডোম্বী আমি কাপালিক, তোর জন্যে আমি হাড়ের মালা নিলাম।
১৩,১৪ : সরোবর ভেঙে ডোম্বী মৃণাল খায়, ডোম্বী, তোর আমি প্রাণ নিই। (আধুনিক বাংলায় অনুলিখনঃ রাজদীপ রায়)

চর্যাপদের ছন্দ মূলত পয়ার আর ত্রিপদীতে আবদ্ধ। ১৬ মাত্রার ‘পাদাকুলক’ ছন্দেই বেশিরভাগ পদ রচিত হয়েছিল। সিদ্ধাচার্যরা তত্বকথার ব্যাখ্যা ব্রাহ্মণদের থেকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে ছন্দের প্রতি যত্নবান হতে পারেন নি। আর এই অযত্নের চর্চাতেই সৃষ্টি হয়ে গেল বাংলা কবিতার এক নতুন আঙ্গিক, চর্যাপদ।

 

সাহিত্য এবং শিল্পকলা জড় বস্তু নয়। স্থিতাবস্থার প্রতিনিধিরা বারেবারেই যে কোন উন্মোচনকে বাধা দিয়েছে, উন্মোচনকারীদের উপর নামিয়ে এনেছে চরম অত্যাচার, সফল হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রধর্ম এই কুকর্মের জন্য এখনো সক্রিয়। এই যে স্ট্রাকচারাল সৃষ্টির কথা লিখলাম, আমি নিজে সেই পরম্পরা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি আর এটা জেনেই যে আমি প্রথম ব্যক্তি নই যে এই মুক্তি চেয়েছে। স্ট্রাকচারের আবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়ার তাগিদে গড়ে উঠেছে নানাবিধ সাহিত্যভাবনা আর আন্দোলন। পোস্ট-স্ট্রাকচারাল সাহিত্যভাবনা এই প্রক্রিয়ারই অংশ। কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত গঠন, বিষয়, একমাত্রার প্রকাশ থেকে মুক্ত করার তাগিদেই ১৮৯০ সালে উইলিয়াম জেমস-এর গবেষণামূলক লেখা ‘দ্য প্রিন্সিপলস অফ সাইকোলজি’তে উঠে এল ‘স্ট্রিম অফ কনসাশনেস’ শব্দটি। উনি লিখলেন, ‘it is nothing joined; it flows. A river or a stream is the metaphors by which it is most naturally described. In talking of it hereafter, let’s call it the stream of thought, consciousness, or subjective life..’


মূলত বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গদ্য সাহিত্যকে পাল্টে দিয়েছিল এই ভাবনাটি। ‘জেমস জয়েস’, ‘ভার্জিনিয়া উলফ’, ‘ডেভিড লজ’ এই ধারার উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিতায় উদাহরণ কম তবে রবার্ট গ্রেভসের(১৮৯৫-১৯৮৫) কবিতা, ‘আ বয় ইন চার্চ’-এ এই ভাবনার প্রয়োগ দেখা যায়ঃ

“Gabble-gabble,… brethren, …gabble – gabble!”
My window frames forest and heather.
I hardly hear the tuneful babble,
Not knowing not much caring whether
The text is praise or exhortation,
Prayer or thanksgiving, or damnation.

Outside it blows wetter and wetter,
The tossing trees never stay still.
I shift my elbows to catch better
The full round and sweep of heathered hill.
The tortured copse bends to and fro
In silence like a shadow-show.

এর ফলে কবিতার ভাবনামুক্তি ঘটে গেল।গান থেকে, সুরের বেষ্টনী থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হল উচ্চারণ।তবে গান কথা আর সুরের সমন্বয়ে হলেও এই মিশ্রণটা কথাকার, সুরকার এবং গায়ক মিলে করেন। কবিতায় এই ভেজাল চলবে না। কবিতার উদ্দেশ্য একটি আলাদা পাঠকগোষ্ঠী এটা কবি বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই কবিতাকে গান থেকে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।সুরের গঠন থেকে পদ্য’র মুক্তি পাওয়ার তাগিদেই এল ‘ফ্রি ভার্স’।

Free verse is an open form of poetry which in its modern form arose through the French ‘verse libre’  form. It does not use consistent meter patterns, rhyme, or any musical pattern.[1] It thus tends to follow the rhythm of natural speech.’


গুস্তাভ কাহ্নের ‘লা ভোগ’ পত্রিকায় ১৮৮৬ সাল থেকে ‘ভার্স লিবর’ বা ‘ফ্রি ভার্স’-এর চর্চা শুরু হয়। কবিতা থেকে মাত্রা, ছন্দ এবং সাঙ্গীতিক গঠন বাদ দিতে শুরু করেন কবিরা। খুব অবাক লাগে যখন দেখি এই বাংলায় এখনো ফ্রান্সে ১৮৮৬ সালে ছেড়ে আসা কবিতার ফর্মে লিখতে থাকা কবিদের ‘মেজর কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এই প্রগাহৈতিহাসিক চর্চাকেই মূলধারা হিসেবে গন্য করা হয়।এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যাঁরা ‘ফ্রি ভার্স’-এর চর্চা করেছিলেন তাঁদের মধ্য ছিলেন, বোদলেয়ার,ভার্লেঁ,র‍্যাঁবো,মালার্মে’র মত কিংবদন্তিরা।‘নতুন কবিতা’র ভাবনা নিয়ে যখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম তখন আমাদের নানা তাচ্ছিল্য এবং বিরোধিতার মধ্যে থাকতে হয়েছিল, বাংলাভাষায় স্থিতাবস্থার পক্ষে এক অমোঘ টান আছে, তার বাইরে যাওয়ার জন্য সহজলভ্য ‘খিস্তি’ ছাড়াও অনেক পথও আছে, তবে যাঁরা এই পথের পথিক তাঁদের হজম করার মত পরিপক্ক মেধাবী কল্পনার মনন এই ভাষায় এখনো কম, অনেক কম। ইওরোপে এই সমস্যাটা নেই, সমালোচনা ছিল কিন্তু স্থিতাবস্থাকেই শিরোধার্য করার মানসিকতা ছিলনা। যাইহোক মূল প্রতিপাদ্যে ফেরা যাক। ‘ফ্রি ভার্স’ আর ‘ব্ল্যাংক ভার্স’ বা অমিত্রাক্ষর ছন্দ এক নয়।এটা কবিতাপ্রেমীরা কমবেশি জানেন। ‘ব্ল্যাঙ্ক ভার্স’ কবিতাকে মুক্ত করেছিল অন্তমিলের বাধ্যবাধকতা থেকে যার শুরু ১৫৬১ সালে থমাস নর্টন আর থমাস স্যাকভিল-এর নাটক ‘Gorboduc’ থেকে। পরে শেক্সপীয়র এই ‘ফর্ম’টিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। মজার ব্যাপার হচ্ছে শেক্সপীয়র কিন্তু সম্ভাব্য ‘ফ্রি ভার্স’ও লিখে ফেলেছিলেন।প্রথমে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ থেকে ব্ল্যাংক ভার্স পড়া যাকঃ

‘Ye elves of hills, brooks, standing lakes and groves,
And ye that on the sands with printless foot
Do chase the ebbing Neptune, and do fly him
When he comes back; you demi-puppets that
By moonshine do the green sour ringlets make
Whereof the ewe not bites; and you whose pastime
Is to make midnight mushrooms, that rejoice
To hear the solemn curfew; by whose aid,
Weak masters though ye be, I have bedimmed
The noontide sun, called forth the mutinous winds,
And 'twixt the green sea and the azured vault
Set roaring war – to the dread rattling thunder
Have I given fire, and rifted Jove's stout oak
With his own bolt;...

 The Tempest

এবার সম্ভাব্য ‘ফ্রি ভার্স’ঃ   

My lord?
            A grave.
                        He shall not live.
                                                Enough.

   King John,3.3

শেক্সপীয়রকে আমার অনেকসময় কবিতার আইনস্টাইন বলে মনে হয়।১৫৬৪-১৬১৬, বাহান্ন বছর বয়সের মধ্যে তিনি সাহিত্যকে নতুন করার তাগিদে কত যে বিচিত্র পথে গিয়েছেন ভাবলেই শিহরণ হয়।এই বাংলাদেশে অবশ্য বিচিত্র হওয়াটাই অপরাধ, একবিংশ শতাব্দীতেও বাংলাভাষার মহাকবি এবং কবিরা মাত্রাশাসিত পদ্য লেখেন এবং মনে করেন, কবিতার ভাবনাপদ্ধতির জন্য চেতনার ক্রিয়াশীলতার কোনও প্রয়োজন নেই, কয়েক শতাব্দী পুরনো আঙ্গিকে চমকপ্রদ পংক্তি রচনা করাই যথেষ্ট। এই যে গান ও কবিতার পারস্পরিক লেনদন নিয়ে এই নিবন্ধের অনেকটা জুড়ে অনেক তথ্য ইত্যাদি দিলাম এর কারণ একটাই যে আমি মনে করি কবিতাকে গান থেকে মুক্তি দিতে হবে। গানের গঠন থেকে।বাংলাভাষা এমনিতেই সুরেলা। সুর বাংলা শব্দে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে।যাইহোক আমার চাওয়াটা কোন আচমকা আকাশপাড়া চাওয়া নয়, কবিতার ছন্দমুক্তি এবং গানমুক্তি শুরুই হয়েছিল ‘ব্ল্যাংক ভার্স’ আর ‘ফ্রি ভার্স’-এর চর্চা থেকে।‘ফ্রি-ভার্স,-এর উদাহরণ বেশি দেবোনা, কয়েকটি দেওয়া যাকঃ

১.Anguish   - Arthur Rimbaud  

 Is it possible that She will have me forgiven for ambitions continually crushed,

-- that an affluent end will make up for the ages of indigence,

-- that a day of success will lull us to sleep on the shame of our fatal incompetence?

 (O palms! diamond!-- Love! strength!-- higher than all joys and all fame!—

 in any case, everywhere-- demon, god,-- Youth of this being: myself!)

 That the accidents of scientific wonders and the movements of social brotherhood

 will be cherished as the progressive restitution of our original freedom?...

 But the Vampire who makes us behave orders us to enjoy ourselves

 with what she leaves us, or in other words to be more amusing.

Rolled in our wounds through the wearing air and the sea;

 in torments through the silence of the murderous waters and air;

 in tortures that laugh in the terrible surge of their silence.

 

২.When I heard the learn’d astronomer – Walt Whitman

When I heard the learn’d astronomer,

When the proofs, the figures, were ranged in columns before me,
When I was shown the charts and diagrams, to add, divide, and measure them,
When I sitting heard the astronomer where he lectured with much applause in the lecture-room,
How soon unaccountable I became tired and sick,
Till rising and gliding out I wander’d off by myself,
In the mystical moist night-air, and from time to time,
Look’d up in perfect silence at the stars.


৩. The red wheelbarrow    Carlos Williums Carlos

so much depends
upon

 

a red wheel
barrow

 

glazed with rain
water

 

beside the white
chickens


আর রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে লিখলেনঃ

‘রোজই থাকে সমস্ত দিন কাজ, আর চারদিকে লোকজন। রোজই মনে হয়, সেদিনকার কাজে সেদিনকার আলাপে সেদিনকার সব কথা দিনের শেষে বুঝি একেবারে শেষ করে দেওয়া হয়। ভিতরে কোন কথাটি যে বাকি রয়ে গেল তা বুঝে নেবার সময় পাওয়া যায় না।

আজ সকাল বেলা মেঘের স্তবকে স্তবকে আকাশের বুক ভেরে উঠেছে। আজও সমস্ত দিনের কাজ আছে সামনে, আর লোক আছে চারদিকে। কিন্তু, আজ মনে হচ্চে ভিতরে যা-কিছু আছে বাইরে তা সমস্ত শেষ করে দেওয়া যায় না।

মানুষ সমুদ্র পার হল, পর্ব্বত ডিঙিয়ে গেল, পাতালপুরীতে সিঁধ কেটে মণি-মানিক চুরি করে আনলে, কিন্তু একজনের অন্তরের কথা আরেকজনকে চুকিয়ে দিয়ে ফেলা, এ কিছুতেই পারলে না।

আজ মেঘলা দিনের সকালে সেই আমার বন্দী কথাটাই মনের মধ্যে পাখা ঝাপ্‌টে মরচে। ভিতরের মানুষ বল্‌চে; “আমার চিরদিনের সেই আররেকজনটি কোথায়, যে আমার হৃদয়ের শ্রাবণ মেঘকে ফতুর করে তার সকল বৃষ্টি কেড়ে নেবে!'”

আজ মেঘলা দিনের সকালে শুন্‌তে পাচ্চি সেই ভিতরের কথাটা কেবলি বন্ধ দরজার শিকল নাড়চে। ভাবছি, “কী করি! কে আছে যার ডাকে কাজের বেড়া ডিঙিয়ে এখনি আমার বাণী সুরের প্রদীপ হাতে বিশ্বের অভিসারে বেরিয়ে পড়বে? কে আছে যার চোখের একটি ইসারায় আমার সব ছড়ানো ব্যথা এক মুহূর্ত্তে এক আনন্দে গাঁথা হবে, এক আলোতে জ্বলে উঠবে? আমার কাছে ঠিক সুরটি লাগিয়ে চাইতে পারে যে, আমি তাকেই কেবল দিতে পারি। সেই আমার সর্ব্বনেশে ভিখারী রাস্তার কোন্ মোড়ে?’

 আমার ভিতর মহলের ব্যথা আজ গেরুয়াবসন পরেচে। পথে বাহির হতে চায়, সকল কাজের বাহিরের পথে,—যে-পথ একটিমাত্র সরল তারের একতারার মত, কোন্ মনের মানুষের চলায় চলায় বাজ্‌চে।‘ (লিপিকা)


রবীন্দ্রনাথ এরপরেও ছন্দে ফিরেছেন কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর নিজের লেখাকেও মুক্ত করেছেন ‘গান’ থেকে। কিন্তু কোথাও একটা দোলাচল ছিল তাঁর মধ্যে। কোথাও যেন মুক্তছন্দের কবিতা অণুগল্পের রেশ তুলে ধরছিল।কিন্তু জীবনের শেষ লেখায় তিনি সম্পূর্ণ গানের গুণ মুক্ত কবিতাই লিখলেনঃ

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে--

কে তুমি,

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--

কে তুমি,

পেল না উত্তর। (শেষ লেখা)

 

তবে কবিতাকে গান থেকে মুক্ত করে স্বয়ংক্রিয় ভাবনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সিম্বলিস্ট, ইমেজিস্ট, ডাডাইস্ট ইত্যাদি ভিভিন্ন কবিতাভাবনা আর আন্দোলনের উত্তরসূরি হিসেবে দানা বাঁধল ‘সুররিয়াল’ আন্দোলনে। আমাদের দেশে তখন রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য কবিরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনার নিরিখে মূলত ফর্মাল কবিতাতেই আস্থা রেখেছেন।যে জীবনযাপন আর সামাজিক নেগেশনের মাধ্যমে ফ্রান্সে সুররিয়াল আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল , সেই ধরণের র‍্যাডিক্যাল ভাবনা চিন্তার অবকাশ পরাধীন ভারতে ছিলনা। অনেকক্ষেত্রে সামাজিক বিধিনিষেধ, শ্লীল বা অশ্লীলতার ঘেরাটোপ, যৌনতা সহ বিভিন্ন বিষয়ের অবদমনজনিত সংকোচ এই দেশে কবিতার স্বাধীন পরিসরকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল। ‘সুররিয়াল’ আন্দোলন এইসবকিছুই লণ্ডভণ্ড করে দিলঃ

‘Surrealism is Pure psychic automatism by which it is intended to express, either verbally or in writing, the true function of thought. Thought dictated in the absence of all control exerted by reason, and outside all aesthetic or moral preoccupations.’ এরফলে কবিতা গানের খোলস মুক্ত হল অনেকটাই। সয়ংক্রিয় ভাবনার ধারাবাহিক বিচ্ছুরণ ভেঙে দিল গান আর কবিতার জোড়ে জমাট বসে থাকা বিভিন্ন মাত্রা, প্রকরণ, সুরগম্যতা ইত্যাদি। কবিতা গান আর পদ্য’র হাত ছেড়ে সাবালকত্বের দিকে পা বাড়াল।না, বাংলা কবিতায় তখনো, সেই ১৯২৪ সালে যখন আঁন্দ্রে ব্রেতোঁ  ‘সুররিয়াল মেনিফেস্টো’ প্রকাশ করছেন, হ্যাঁ তখনো স্ট্রাকচারাল কবিতারই রাজত্ব। পুরোধ অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনের ভিতটি ব্রাহ্ম সমাজের দীক্ষিত বীক্ষায় গড়ে উঠেছিল। সেখানে ‘মরালিটি’র শাসন ছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রেমিক ছিলেন, সংযমীও ছিলেন। ফ্রান্সের সুররিয়াল কবিতাভাবনা এবং জীবনযাপনের অসংযমী অনুশাসনহীন  এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাব রবীন্দ্রনাথের থাকার কথা নয়, ছিলও না।

 

তিরিশ থেকে পঞ্চাশ, এই কুড়ি বছরে বিভিন্ন কবিদের নিজস্ব লিখনভঙ্গীর খোঁজ কখনো গানের গঠনকেই আঁকড়ে ধরেছে, কখনো বা ইংরেজি এবং ফরাসি সাহিত্যের প্রভাবে গান বর্জিত লেখায় পৌঁছেছে। একদিকে ছিলেন, বুদ্ধদেব বসু। যিনি দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার ‘ক্যাটালিস্ট’ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাভাবনা, লিখনশৈলী থেকে এই সময়েই ‘কবিতা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা কবিতা সরে যেতে থাকে। আর অন্যদিকে একাই ছিলেন ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালিখি করা একমেবদ্বিতীয়ম জীবনানন্দ দাশ। একান্তেই তিনি ভেঙে দিলেন বাংলা কবিতায় সুপ্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র উচ্চারণ এবং গানের কাঠামোও!

‘আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠছে:
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হ’য়ে উঠছে।

মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন,
কোনো এক প্রাসাদ ছিলো;
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ:
পারস্য গালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা,
আর তুমি নারী—
এই সব ছিলো সেই জগতে একদিন।

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক;
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো,
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।

ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতে রঙিন পর্দায়-পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস—
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।

পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমার নগ্ন নির্জন হাত;

তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
   (নগ্ন নির্জন হাত/ জীবনানন্দ দাশ)

 

রবীন্দ্রমুক্ত উচ্চারণের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? জীবনানন্দ এটা করেছিলেন তাঁর নির্জনতম জীবনযাপনের আড়ালে এক গভীর চেতনাভ্যাস দিয়ে।এই যে গঠনের আর প্রথাগত ছন্দের বেড়া ভেঙে বাংলা কবিতাকে জীবনানন্দ নিয়ে এলেন নতুন ভাবনার পরিসরে, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ভাবনার এই বিশাল লাফটি বাংলা কবিতায় এখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। পেলে গানধর্মী পদ্য আর কবিতা আলাদা মান্যতা পেত। পায়নি। কিছু ব্যতিক্রমী বেশিটাই ব্যক্তিগত অনুশীলন ছাড়া ভাবনার চেতনানুসারি অভিযান বাংলা কবিতায় সেভাবে হয় নি। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কবিতা হয়না, এটা যাঁরা বলেন, তাঁরা কেন বলেন আমি জানিনা। আধুনিক কবিতার পর্যায় থেকে সারা দুনিয়া আজ অবধি যত নতুন ধারার কবিতা স্বীকৃত হয়েছে তার আশি শতাংশই গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।কবিতা বা যে কোনও লেখালিখি কেউ দলবেঁধে লেখে না।হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা স্ট্রাকচার ভেঙে নতুন কিছু করার জন্য যে চিন্তা ভাবনাগুলো বিছিন্ন হয়ে ছিল তারা একটা বিশেষ সময়ে পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত হল। কবিতাকে ছন্দের শাসন, গানের বয়ন থেকে মুক্ত করা ছিল দুরূহতম সাহিত্যিক বিপ্লব যা আধুনিক সমাজের মুক্ত চিন্তার পরিসরে সক্রিয় হতে পেরেছিল।একই সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি (শিল্প বিপ্লবের থেকে শুরু)এই মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞান হাজার হাজার বছরের অন্ধকারে জ্ঞানের আলো ফেলছিল।সাহিত্যও আলোকিত হচ্ছিল।


এই নিবন্ধে আগে দেখানো হয়েছে কিভাবে কবিতা আর গান এবং তাদের গঠনপ্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। এই মিশ্রণটা হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।আর ব্ল্যাংক ভার্স, ফ্রি ভার্সের মাধ্যমে কবিতার গানমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার ইতিহাস মাত্র কয়েকশো বছরের। লেখ্য’কে তার মুল অবয়ব থকে বিছিন্ন করে একটি ‘কোড’ বা সংকেতে নিয়ে আসার প্রস্তাবনা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টরা করেছি্লেন কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল, ‘language is not a transparent medium that connects one directly with a “truth” or “reality” outside it but rather a structure or code, whose parts derive their meaning from their contrast with one another and not from any connection with an outside world.’ রোলাঁ বার্থ, জ্যাক লাকাঁ,জুলিয়া ক্রিস্তেভা, মিশেল ফুকো প্রমুখদের এই চিন্তাপদ্ধতি বিশ্বসাহিত্যের ধারাবদল ঘটিয়ে দিল, যদিও, এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য এখনকার মত তখনো মাত্রাশাসনের আদর আর যত্নে লালিত হচ্ছিল।তবে কবিতার ক্ষেত্রে আমূল বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন চিলির নিকানর পারা এবং গ্রীসের এলিয়াস পেত্রোপাউলাস প্রতিকবিতা লিখতে শুরু করে। জ্যাক দেরিদার ‘বিগঠন’ এবং রোলাঁ বার্থের ‘লেখকের মৃত্যু’ প্রতিকবিতায় আধার পেয়ে গেল।কবিতা মুক্তি পেল গানের গঠন থেকে।পড়া যাক এলিয়াস পেত্রোপাউলাসের কিছু প্রতিকবিতাঃ

I'm disgusted by people who wear pajamas.
Pajamas make me think of petit-bourgeois interiors.
They make me think of senility and hospitals. ( after-1, translated by John Taylor)

 

I know all your little ways.
How you look when you tell lies.
How you slice meat with a knife.
How your skin smells.
I put my head on your stomach:
your innards are grumbling.
A Woman, you love everything about her,
or nothing at all. (after-2, translated by John Taylor)


এবং যাঁকে ছাড়া প্রতিকবিতা ভাবাই যায়না সেই নিকানর পারার কবিতাও পড়া যাকঃ

১.

Whether we like it or not,
We have only three choices:
Yesterday, today and tomorrow.

And not even three
Because as the philosopher says
Yesterday is yesterday
It belongs to us only in memory:
From the rose already plucked
No more petals can be drawn.

The cards to play
Are only two:
The present and the future.

And there aren't even two
Because it's a known fact
The present doesn't exist
Except as it edges past
And is consumed...,
like youth.

In the end
We are only left with tomorrow.
I raise my glass
To the day that never arrives.

But that is all
we have at our disposal.

 

২.

In case of fire
Do not use elevators
Use stairways
unless otherwise instructed

No smoking
No littering
No shitting
No radio playing
unless otherwise instructed
Please Flush Toilet
After Each Use
Except When Train
Is Standing At Station
Be thoughtful
Of The Next Passenger
Onward Christian Soldiers
Workers of the World unite
We have nothing to loose [sic]
but our life Glory to the Father
& to the Son & to the Holy Ghost
unless otherwise instructed
By the way
We also hold these truths to be
self evident
That all man [sic] are created
That they have been endowed
by their creator
With certain inalienable rights
That among these are: Life
Liberty & the pursuit of happiness
& last but not least
that 2 + 2 makes 4
unless otherwise instructed


৩.

Write as you will
In whatever style you like
Too much blood has run under the bridge
To go on believing
That only one road is right.

In poetry everything is permitted.

With only this condition of course,
You have to improve the blank page.

কবিতা আর গানের যাবতীয় আবশ্যিক মেলবন্ধন প্রতিকবিতার আবহে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল, তবে বাংলায় নয়।আবশ্যিক কথাটা লক্ষ্য করুন।প্রতিকবিতা শেখালো গানের তথাকথিত আবেশ বাদ দিয়ে কবিতা লেখা যায়।বিষয় ব্যাপারটাই অহেতুক।সমস্ত মিথ, কবিতা আর গান সংক্রান্ত ভেঙে পড়ল।আর প্রতিকবিতাও কবিতাধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেল।

 

নব্বইয়ের শুরুতে যখন আমরা কয়েকজন কবিতাকে নতুন করার কথা ভাবছি তখন বাংলা কবিতায় কিন্ত এতসব ঘটেনি। হাংরি,প্রতীকবাদী,শ্রুতি’র জোরদার উপস্থিতি সত্ত্বেও বাংলা কবিতায় আমরা মনে করেছিলাম এই ধারাগুলোই রাজত্ব করছেঃ

১. জীবনানন্দের ধারা।মূলত যা পরাবাস্তবিক।

২. সঙ্গীতাঙ্গিক কবিতার ধারা। যাকে পদ্য বলা যেতে পারে।

৩. বক্তব্য সম্বলিত কবিতার ধারা।

কবিতাভাবনা যদি চেতনাচালিত না হয় তাহলে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়না। সময়শাসিত কবিতাধারার চেয়ে চেতনাশাসিত কবিতাধারাগুলি তাই অতীতে দীর্ঘায়ু হয়েছে।ওই সময় আমি এবং আমরা যে ভাবনায় জারিত হচ্ছিলাম তার মূল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল পরাবাস্তববাদ এবং বাংলা কবিতার জীবনানন্দীয় ধারা।ভাবনা আর জারণের প্রক্রিয়ায় নানাবিধ মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে বারীন ঘোষালের ‘অতিচেতনা’ আমাদের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠল।কেন্দ্রচ্যুত চেতনার অভিযানে আমিও শামিল তখন, পুরোটা না জেনেই। আমার কাছে গান ছিল শরীরের অংশ, প্রতিকবিতায় গানের গঠন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল, বাংলা কবিতায় যদিও তা হয়নি। এরফলে, কবিতাকে নতুন করার ক্ষেত্রে কাছে অনিবার্য হয়ে উঠলঃ

১. অতিচেতনা

২. বিষয়হীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া

৩. মাত্রাবদ্ধ পদ্যের বাইরে চেতনাসঞ্জাত কবিতা লেখা্র চেষ্টা করা

৪. গানের মিটার আর কবিতার মিটার যেভাবে এক হয়ে ছিল বাংলা কবিতায় তার থেকে বেরিয়ে আসা।

বারীন ঘোষাল অতিচেতনার কথায় লিখলেন, ‘বিশ্বসংসার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গে ভাসছে।তার একশো ভাগের মাত্র ৬ ভাগ প্রতিফলন আমরা খোলা চোখে দেখতে পাই।মানুষের সমস্ত শিল্পকলা সংস্কৃতি বিস্ময় আগ্রহ ঐ ৬ ভাগে সীমিত। অতিচেতনা এই সীমা ভেঙে দেয়। চেতনাকে ছড়িয়ে পড়তে দেয়। ঐ যা ছিল চেতনার বাইরে, যার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি অসাধারণ অবাক প্রতিফলনে তাকে extra consciousness বলা চলে।super না, তাতে quality বা গুণ বোঝায়। আমাদের অভিজ্ঞতা অভ্যাস ও মিথ এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।সীমানা ভাঙার ফলে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে ভাবনা ও ধারণাগুলো, যা আছে অথচ ছিল অনলদ্ধ তার হঠাতছোঁয়া দেয় সেই ভীষণ অবকাশ, যা অতিচেতনার পরিসর।একে extra বলাই ঠিক।অস্তিত্ব বোঝা যায়, বর্ণনা করা যায় না।এতদিন যা বাস্তব ভেবেছি আজ তা ছাপিয়ে ফুটে উঠছে এক অতিবাস্তব এবং সবকিছুর মানে বদলে যাচ্ছে। একটা বস্তুর শারীরিক মাপ জানা যায়।জানা যায় তার বীক্ষিত গঠন।দুটো বস্তুর অনুরূপ ছবি বিভিন্ন কোণ থেকে তুললে এবং একসাথে বিচার করলে, বা একেবারেই চারপাশ থেকে দেখতে পেলে অবস্থান আপেক্ষিকতার অনুমান করা যায়;কিন্তু বোঝা যায় না ওদের মধ্যকার চৌম্বক টান, মাধ্যাকর্ষণ, বোঝা যায় না ওদের কোয়ার্ক বা আলো বা বয়স, বোঝা যায় না ওদের শক্তি, ভবিষ্যৎ বা বিস্ফোরণের সম্ভাবনার কথা। হয়ত অপরিষ্কারভাবে বা পরিষ্কারভাবেই এর সম্পূর্ণ গুরুত্ব টের পাওয়া যায়।যেভাবে, তাকেই বলেছি অতিচেতনা।’ (অতিচেতনার কথা/বারীন ঘোষাল)


কবিতাকে গানমুক্ত করা মানে এই নয় যে গানের গুণমুক্ত করা।গান আর কবিতা কিছু পিছুটান নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে দুটো ফর্মেই গোঁজামিল কম হয়ে যাবে।বাংলা কবিতার নব্বই পরবর্তী সময়ে এটা হচ্ছে,অনেক তরুন কবিই গান,পদ্য আর কবিতার পার্থক্য জানেন এবং সেভাবেই লেখেন। ষাটের দশকে ইওরোপের কিছু বহু পুরনো কবিতা আন্দোলনের ছায়ায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছিল যেখানে গানের ছায়াও ছিলনা। এখন বেশ কিছু কবির লেখায় একধরণের নবায়ন ঘটছে যেখানে গানের কাঠামো নেই কিন্তু সুর আছে। আবার গান বিবর্জিত,সুর বিবর্জিত লেখাও রয়েছে। মাঝেমাঝে মনে হয় একটা কাঠামোর বদলে কিছু তরুন কবি অন্য আরেকটা কাঠামো তৈরি করছেন। এটাকে বলে জল মেশানো।কবিতার কাঠামো আর কাব্যপ্রতিমাকে অস্বীকার না করলে কোনোভাবেই ধারামুক্ত হবে না কবিতা। আর সেই ধারামুক্তি ঘটতে পারে চেতনার সাহায্যে।পুরনো চেতনাকে ত্যাগ করে নতুন চেতনায় নিজেকে ঋদ্ধ করে। গান আর কবিতা এপথেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে একদিন।





Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger