Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।

রোয়াক অবসরে দ্বিতীয় গ্রুপ ডিসকাশনের সূত্র ছিল এই ছবিটি।

সাদা পাতা থেকে লিপিত কবিতার সামনে 

স্বপন রায়, দেবাঞ্জন দাস, অরবিন্দ রায় এবং শঙ্খদীপ কর 

 

শঙ্খদীপ কর- এবার আমাদের বিষয় ধরা যাক কেন্দ্রে কবিতা। প্রথমেই যাবো স্বপন দার কাছে। জানতে চাইবো, এই ছবিটা নিয়ে তোমার কী ধারণা? কী অনুভব তৈরি হয়েছে সেটা নিয়ে বলো।

 

স্বপন রায়- কেন্দ্রের কবিতা বা কেন্দ্রে কবিতা এটা নিয়ে আমি ভাবনাচিন্তা করছিলাম। খুব মজার একটা কথা বলি। এটা তো আর সময় নিরপেক্ষ নয়। তো যখন কেন্দ্র নিয়ে ভাবছিলাম একটা গান মনে পড়ছিলো আমার। “আনেওয়ালা পল যানেওয়ালা হ্যায়”।  সেটাকেই একটু ঘুরিয়ে বললে “আনেওয়ালা কল আনেওয়ালা হ্যায়” । আমাদের পরিচিত আই আই টির এক প্রফেসর ছিলেন। আর উনি শেরশায়েরিতে ওস্তাদ ছিলেন। লক্ষ্ণৌর লোক। তো আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একবার, এই লার্জ হেড্রন কোলাইডার, এ কী? তারা কী চায় আসলে? কী হবে? এখানে যে কবিতার কেন্দ্র বলা হল, তো আরও বিস্তারিত অর্থে তারা তো একটা কেন্দ্রে যেতে চাইছে, যখন আমাদের ইউনিভার্স তৈরি হয়, সেই সময়কার কাছাকাছি তাপমাত্রা, দুটো প্রোটন কণার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে সেখানে যেতে হচ্ছে কারণ তাদের কাছে একটাই লক্ষ্য, ডার্ক এনার্জি এবং অ্যান্টি ম্যাটার। ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সময় সমপরিমাণে ওই দুটোই তৈরি হয়েছে , হয়তো একটু বেশিই। ওটার খোঁজ পাওয়া গেলে সবটাই পালটে যাবে। পুরো ম্যাপ পালটে যাবে। আমি তখন বললাম যে আমি ধরে নিলাম যে হিসেবটা হচ্ছে, দশমিকের পর বিয়াল্লিশটা শূন্য, তারপর এক। কিন্তু সেই সময়ে পৌঁছে কী দেখব? তখন উনি বললেন যে হয়তো দেখব আপসাইড ডাউন হয়ে গেছে। মানুষ উল্টো দাঁড়িয়ে আছে। জলের বোতল উল্টো হয়ে আছে। এটা একটা পসিবিলিটি। ওর জন্যেই এই গানটাকে একটু ঘুরিয়ে বললাম। এর সাথে আমার আরেকটা জিনিস মনে হচ্ছে, এই যে আমরা কেন্দ্র খুঁজছি কবিতার। এরকম হতে পারে কী, যে এই যে আমরা কবিতার কেন্দ্র খুঁজছি, ইউনিভার্সের কেন্দ্র খুঁজছি, কেন্দ্র থেকে সরতে চাইছি, এই পুরোটাই একটা গেম প্ল্যান? এরকমও তো হতে পারে,অন্য কোনো ইউনিভার্সের স্কুলে পড়া বাচ্চা একটা ছেলে এই প্রোগ্রামটা করেছে? এবং সিমুলেশন করেছে? আমাদের যা যা হলো, সেটা হয়তো একটা আর্টিফিশিয়াল ইউনিভার্স, যেখানে আমরা আছি এবং তার প্রোগ্রাম অনুযায়ী নানা ধরনের পার্টিকল তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে বিক্রিয়া হয়েছে, প্রকরণ হয়েছে, এবং আমাদের যে ধ্বংস হবে, সেটাও সে প্রোগ্রাম করে রেখেছে? এর সাথে আলোচনার সম্পর্ক হচ্ছে এই, যে পুরোটাই যদি প্রোগ্রামড হয়, তাহলে আমরা সবাই আনরিয়াল, তাহলে আমাদের লেখালিখি, আমাদের জার্নি, যার সমস্ত কিছু দেখছি, তা আমাদের হাতে আর নেই। এটা অলরেডি প্রি প্রোগ্রামড। এরকম তত্ত্বও আছে, যে এই ব্রহ্মান্ড আর্টিফিশিয়ালি ক্রিয়েট করা, বাই সাম সুপার ইনটেলিজেন্ট বিয়িংস, এবং আমরা সেই অতি বুদ্ধিমানদের খেলার বস্তু। “খেলিছ এ বিরাট শিশু এ বিশ্ব লয়ে” এই জন্যেই বললাম, যে এই যে কেন্দ্রে যাওয়া, এবং তা থেকে বেরিয়ে যাওয়া, এর প্যারালাল যদি টানি আমি কবিতার ক্ষেত্রে, যে কবিতা হয়ে আছে, তো আমি বলি, কবিতাও প্রোগ্রামড হয়ে আছে। কাল রাত্রেও কথা হচ্ছিল যে স্যুররিয়ালিস্টরা কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হতো, কেন্দ্রাভিগ হতে চেতনা বেরিয়ে গেলে যে ডায়াগ্রাম, এই মতপার্থক্য, এই লেখা, সমস্তই আগে থেকে প্ল্যান করা আছে। চেতনার যে কেন্দ্রাভিগ ও কেন্দ্রাতিগ জার্নি, তাও খেলার অংশ। কবিতা আসলে একটা খেলা। ইটস আ গেম।

 

দেবাঞ্জন দাস- এই যে ব্রহ্মান্ডের ছবি, সাবজেক্ট রাখা হল, ধরা যাক কেন্দ্রে কবিতা, যদি এরকমভাবে বিষয়টা দেখি, যে কবিতাকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মান্ড কল্পনা করা হলো, আমি সেটাকে রূপক হিসেবে ধরছি। আমি ধরতে চাইছি, যারা কবিতা ভালোবাসে, তাদের কেন্দ্র করে যে পরিমন্ডলটি তৈরি হয়, কারণ ব্রহ্মান্ডের বিষয়গুলি নিয়ে আমার কিছু জানা নেই। ফলে বিজ্ঞানের বিষয়ের মাধ্যমে কবিতাকে আলোকপাত করার ব্যাপারেও আমার বলার কিছু নেই। এইবারে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, দেখুন কবিতা মিডিয়াম হিসেবে বেসিকালি একটা বিশৃঙ্খলার মিডিয়াম। প্লেটো থেকে শুরু করে বহু লোক বহুবার বহুভাবে এই কথাটা বলেছেন। অজস্র রেফারেন্সের কিছু মাথায় রেখে বলা যায়, যেখান থেকে কবিতা সৃষ্টি হয়, এবং যা লিপিত কবিতা, তার ভেতরের যে ফাঁক থাকে, তাকে তো ধরা যায়না। যে লিপিত কবিতা আমি পড়লাম, বা প্রোডিউস করলাম আর যা কনসিভড হলো, তার মাঝে যে ফাঁক, সেই ফাঁক,  লিপিত কবিতা থেকে যখন মানুষ পড়তে শুরু করে, তখন তার ট্রিগারিং শুরু হয় বলে আমার ধারণা। এবং সেই ট্রিগারিং যদি ভাবার চেষ্টা করি, যে ট্রিগারিংগুলো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার সৃষ্টি হলো, তার এক বা একাধিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ লিপিত কবিতা আমি পাঠ করা শুরু করলে এক এক পাঠে তার এক এক রকম পসিবিলিটি উঠে আসতে পারে। সেই পসিবিলিটি ধরে সে একটা চূড়ান্ত ক্যাওস তৈরি করে। আমার এই ছবি থেকে সে কথাই মনে হচ্ছিলো যে কোনো একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে যখন অজস্র চিন্তাবিন্দু তৈরি হয়, তার সজ্জা কেমন হতে পারে। এরকম তো নাও হতে পারে, যে আমাদের ব্রহ্মান্ডের একটা জিওমেট্রিক প্যাটার্ন, যা আমরা দেখতে পাই, যদি তা না থাকে তাহলে কী হবে? সেক্ষেত্রে অজস্র চিন্তাসূত্র তৈরি হতে পারে। এন সংখ্যক চিন্তাসূত্র তৈরি হতে পারে। কিন্তু কেওটিক প্যাটার্নও যদি না তৈরি হয় কবিতার, সেটা নিয়েই আমার জানার ইচ্ছা। সেটা যদি কসমিক সায়েন্সে ইন্টারেস্টেড লোকেরা বলেন, তো ভালো হয়।

 

শঙ্খদীপ কর- তার আগে একটা কথা বলে নিই যে, ছবিগুলো যে বানানো হয়েছে, তার উদ্দেশ্য এরকম ছিলো, যে এখানে এই ছবিগুলোর ওপর আমরা সায়েন্সের আডভান্সমেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। আমার স্পেসিফিকভাবে অন্তত সেরকম উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ আমরা কবিতার ক্যাম্প করছি। ফলে, এখানে পৃথিবী, ব্রহ্মান্ড বা সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। একসময় কান্টের মতবাদ জনপ্রিয় ছিল। তারপর এলো বিগ ব্যাং। প্যারাডাইম শিফট করার মতো তত্ত্বও শিফট করে। কিন্তু এইগুলো বিজ্ঞানের আলোচনা। আমি সেই আলোচনা করবো না। আমি চাইছিলাম, একটা জায়গা থেকে আমরা কবিতা ও সেই সংক্রান্ত আলোচনায় যাবো, তার জন্যেই ডায়াগ্রাম- ধরা যাক, কেন্দ্রে কবিতা। আমি একটা সৌরমন্ডলে যাব। একটা মানসপট তৈরির জন্যেই ডায়াগ্রাম দেওয়া। তো নিশ্চয় তারা আলাদা আলাদা রিয়্যাক্ট করবেন। সেইজন্যে আমি কথায় লিখে স্টেটমেন্ট দিইনি। একটা ছবি দেওয়া, যাতে তা দেখে আলাদা আলাদা রিয়্যাক্ট হয়। ঠিক সেরকমভাবে ভাবা যেতে পারে, ধরে নিই, একটা কবি মানুষের দুটো জীবন। প্রথম জীবন। দ্বিতীয় জীবন। একটা বাস্তব জীবন, চারিদিকের মেটেরিয়ালিস্টিক লাইফ, আরেকটা লাইফ কবিজীবন। আমরা যখন ওই প্রথমজীবনে থাকছি, অর্থাৎ বাজার দোকান-হাট পেশা ইত্যাদিতে থাকছি, তখনও কী তার কেন্দ্রে আমাদের কবিজীবনটা থাকেনা? থাকে বলেই তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোথাও একটা ধ্বনি, একটা দৃশ্য, কোনো সাউন্ড, সমস্ত কিছু থেকেই ট্রিগারিং হতে পারে। হয়েওছে। ফলে কী হয়, প্রথম জীবনের মধ্যে দ্বিতীয় জীবন, যা কবিজীবন, প্রথম জীবনের কেন্দ্রে থাকতে পারে, এটা আমার মনে হয়েছে। এবং এই কেন্দ্রে থাকা দ্বিতীয় জীবন বা কবিজীবন, কেন্দ্রে বলেই চারপাশের সমস্ত ঘটনা তার চারপাশে ঘোরে, গোল কক্ষপথে নাও ঘুরতে পারে, তার কেওটিক প্যাটার্ন থাকতে পারে, কিন্তু সবকিছুর পেছনে সেই কেন্দ্রের কবিজীবন। যেমন শ্মশানে বসে বা শ্মশান থেকে ফেরার পথেও, কোনও কবির মাথায় কোনও লাইন আসতে পারে, এমনকি তার বাবার দেহ দাহ করতে গিয়েও। কারণ তার কেন্দ্রে তার কবিজীবন। একটা দিক গেল। অন্যভাবে বলা গেলে, ধরা যাক, এই যে আমি একটা মানুষ, অথবা, ধরো এমন একজন মানুষ, যার আপাদমস্তক কবিতা, সে একটা চিন্তাচেতনা দিয়ে তার চারপাশে বিভিন্ন ঘটনা ব্যক্তি এবং আর যা যা সম্ভব যা কবিতাকেন্দ্রিক, সেই সমস্তগুলো রোটেট করে, আজ সেরকম উদাহরণস্বরূপ মানুষেরা, ধরি বিনয় মজুমদার, ভাস্কর চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, প্রমুখেরা। তার আশেপাশের যারা ঘোরে, এমন হতে পারে যে তার পারিবারিক ব্যক্তিটি কবিতার পরিমন্ডলে নেই, অথচ সেই কবিমানুষের আশেপাশেই আছে, এই যে পরিমন্ডল, এই পরিবারকেই আমি কবিতা পরিমণ্ডল বলতে পারি। যেমন সৌরমন্ডলে শক্তির উৎস সূর্য। ওই কবিমানুষটি সেই শক্তির উৎস। যেমন আমার খুব কাছের বন্ধু, বাড়িতে কবিতা লেখার জন্য বউয়ের গাল খায়, অথচ তার বউ বিয়েবাড়ি গেলে সেই কবিতার কথাই ফলাও করে লোককে বলে (হাসি) সেও এখানে একটা রোটেশনের অবজেক্ট। এটা আমার মনে হয়েছে। একটা থার্ড পারস্পেকটিভ যদি বলি, কেন্দ্রে কবিতা গড়ে ওঠার জন্য তার চারপাশে যে অরা তৈরি হয়, গ্রহগুলো বাদ দিলে, সূর্য ও তার অরা, একটা কবিতা গড়ে ওঠার সময় একটা আবহ বা অরা তৈরি হয়। যখন লেখা হচ্ছে তার ইটসেলফ একটা অরা থাকে। আমি কি বোঝাতে পারছি? ধরো চিত্তদার সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা মনে আছে। ধরো আমার সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল খুব ভালো লেগেছে। আবোলতাবোলের অনেকগুলোই আমার কাছে, ট্রুলি স্পিকিং, কবিতা। এবং সেখান  থেকে আমি কিন্তু কবিতার এলিমেন্ট, বা রস আস্বাদন করি। ফলে তার অরায় আমি আছি। যে অরার কেন্দ্রে আছে কবিতা। এরকম নানা দিক থেকে আমি ভাবতে পারি। এবং সব ভাবনাই কবিতাকে রিলেট করছে। সৌরমণ্ডল, আমার মনে হয়েছে, এক্ষেত্রে আমার ডিসকাশনের স্পেসিফিক অংশ নয়। এবার অরবিন্দ, তুই বল-

 

অরবিন্দ রায়- আমি একটু আলাদা বলি। এটা যদি আমি ধরি, যে আমার প্রাইমারি ইমাজিনেশন, ধরা যাক, বাইরের আমি একটা ছবি পেয়ে আমার ঘরে এলাম। এই ছবিটা আমার প্রাইমারি ইমাজিনেশন, এবং তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সেটা থেকে আমি যা লিখলাম। সেটা ধরি সেকেন্ডারি ইমাজিনেশন। এবার আমি যদি পাঠককে ধরি, তবে পাঠক যদি আমার এই লেখাটা পড়ে, তাহলে তার মনে যে চিন্তাটা আসবে, তা তার সেন্টার। এই সেন্টার ব্যাপারটাই আমার কাছে প্রাইমারি ইমাজিনেশন বা কবিতার কেন্দ্রক। বাদবাকি সৌরমণ্ডল বা অন্যান্য জিনিস নিয়ে বাকিরা তো বলল।

 

স্বপন রায়- আমি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো মডেল কবিতার বিরোধী। কবিতার কোনও মডেল হয়না। ইটস আ সার্চ। ইটস আ গেম। এই যে ছবিটা দেখে, এইজন্যেই এর প্যারালাল পসিবিলিটিগুলো টানা হলো। যেমন প্যারালাল ইউনিভার্স, ডার্ক এনার্জি, বাউন্স ব্যাক থিয়োরি। এগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয় তখনই, যখন  আমরা এটাকে খেলা হিসেবে ধরি, কবিতার খোঁজের খেলা, চেতনার খোঁজের খেলা । এবং তখনই এই মডেলগুলো মুছে যায়। এই যে আমি বললাম, যে সবটাই প্রোগ্রামড, আমরা কম্পিউটারের কিছু কোড, ফালতু তর্কবিতর্ক করে যাচ্ছি কারণ কোড অনুযায়ী করতে হবে, তখন কি আমরা কোথাও পৌঁছচ্ছি? যাচ্ছি এমন এক জায়গাতে, যেখানে সমস্তকিছু ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাবে। আমাদের লক্ষ্য তাহলে কী? তাহলে একটা মডেলকে অস্বীকার করার জন্য আমাদের একটা জার্নি চাই, আর সেই জার্নিটা, শুধু ভেতরের জার্নি, চেতনার জার্নি, সেই জার্নি দিয়ে সেই ভাবনা দিয়ে তাকে করা যায়। স্যুররিয়ালিস্টরা করেছিল। আবার চেতনার উল্টোস্রোত দিয়ে যদি করা হয়, করা হবে। এবং, ওটাই শেষ নয়। আমাদের আরও ভাবতে হবে, যে কেন্দ্রে সর্বশক্তিমান কেউ বসে নেই। যার যার চেতনার কেন্দ্র আলাদা। এই চেতনার কেন্দ্র একজন মানুষের ব্যক্তিগত জার্নি। এবং এটা অরূপরতন ঘোষ বলতেন, লেখার খেলা। যতক্ষণ আমরা কবিতার মডেল ভাঙতে না পারব, ততক্ষণ খেলা হবে না। আর খেলাটা মিস করে গেলে, কবিতা নিজেই একটা ডাল অবজেক্ট হিসেবে রচিত বা নির্মিত হবে। এবং কবি নিজেও তা এনজয় করবে না।

 

শঙ্খদীপ কর- স্বপন দা যেভাবে বলছো সেভাবেও আমরা ভাবতে পারি। খুব বেশি থিয়োরিতে যাব না। এই যে সবটাই প্রোগ্রামড, এই থিয়োরির বেসিক কথাটাই হচ্ছে যা কিছু রিয়েলিটিতে হচ্ছে, এ আমার চয়েজ নয়। আমি এখানে হাত নেড়ে বলব, নাকি হাঁ করে বলব, সবটাই পূর্ব নির্ধারিত জ্যামিতি। কোয়ান্টাম থিয়োরি তাই বলছে। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে এমন কোনো কণা নেই, যা আলোর চেয়ে দ্রুত। তাই আমাদের কাছে আপাতত সত্য, যে আলোই আমাদের ব্রহ্মান্ডে সবচেয়ে দ্রুতগামী। স্বপন দা বললো না, প্রিপ্রোগ্রামড। যা কিছু আমার সুন্দর লাগে জগতে, তার গণিত আমরা অনেক পরে বার করেছি। ফি, বা গোল্ডেন রেশিও। এই জ্যামিতিটা মানুষ অনেক পরে বুঝেছে। এইভাবে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকে ফিবোনাচ্চি সিরিজ মেন্টেইন হচ্ছে। যা কিছু আমি করছি, তার পেছনে একটা গণিত, একটা প্রোগ্রাম। আমি কী? জন্মের সময় আমার ওজন ৩ কেজি। এখন ৭৫। এই ৭২ কেজি তো অ্যাকুমুলেশন অফ নেচার। আমার মধ্যেই ছিলো। ঠিক সেরকমই, আমার মাইন্ড, আমার চিন্তা চেতনা, সবই হচ্ছে অ্যাকুমুলেশন ফ্রম নেচার। এই যে স্পঞ্জ জল শুষছে যেভাবে, একটা টিসু পেপার সেভাবে জল শুষবে না। কারণ গণিতটাই আলাদা। তন্ময় যেভাবে দেখবে আমি সেভাবে দেখব না। ও যেভাবে লিখবে, আমি সেভাবে লিখবো না। আলটিমেটলি কোয়ান্টাম রিসার্চ তাইই বলছে। এর পেছনে অঙ্ক আছে। তার পেছনে ঈশ্বর আছে কিনা, সে তো বোগাস আলোচনা। কে করেছে বা করেনি, সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না। যে কবিতা আমার দ্বারা লিখিত হচ্ছে, আমি সেই কবিতার চয়েজ। আমি কবিতার চয়েজ। কবিতা আমার চয়েজ নয়। যে জ্যামিতিগুলো, জন্মের আগে থেকে, ইন ফ্যাক্ট, নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে জন্ম অব্দি যে যে খেলাগুলো হয়, মাতৃজঠরের ভ্রূণ, তাও সেই ফি, বা গোল্ডেন রেশিও। ইটস নট আওয়ার চয়েজ। তার মানে আমি যেভাবে কবিতাটা লিখছি সেটা আফটার অল, কীভাবে লিখছি, বা কীভাবে পারব, সেই কেন্দ্রটা কী, কবিতা? আমি এইখানে আসছি। কবি কী কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি কবিতাই কেন্দ্র, যার চারপাশের জার্নিটা আমরা করছি?

 

দেবাঞ্জন দাস- তোমার আগের ও পরের বলা কথা থেকে আমি দুটো অংশ তুলে নিচ্ছি। তুমি বললে না, যে এভাবে বলা হয়, একজন মানুষ, যিনি কবিতা লেখেন, তার কবিতা লেখা ছাড়া আরেকটা জীবন, এবং কবিজীবন। প্রশ্ন হচ্ছে দুটো কী আলাদা জীবন, নাকি একটাই জীবন, একে অপরকে শ্যাডো করে যাচ্ছে? আর তুমি এখন বললে, কবিতাই আসলে কবিকে বেছে নিয়ে তাকে দিয়ে লেখাচ্ছে। এই দুটো বিষয়কে বেছে নিয়ে আমি বলতে চাই আমার মনে হয়, এই যে আমরা বলি, কবিতা হয়ে আছে, কবি তা লিখিত করে, ওখানেই আসতে চাইছি। বারীনদা উদাহরণ হিসেবে দিয়েছিলো, মাছ ধরা, সমুদ্রতট, চাষ করা ইত্যাদি। যে জেলে মাছ ধরছে, সেও কবি। এরকমই একটা কথা অতিচেতনার বইতে বারীনদা বলেছিল সেখানে। এখন আমার সেখান থেকে নেওয়ার বিষয় হচ্ছে, এন্ড অফ দ্য ডে, ব্রহ্মাণ্ড হোক বা প্রকৃতিই হোক, আমি যদি তার অংশ হই, তাহলে তো কবিতা এসেনশিয়ালি হয়েই আছে। আমি যখন কবিতা লিখছি, তখন সেই হয়ে থাকা কবিতাগুলো, সে আমাকে, আমার সেন্সকে  অ্যাপিল করছে বা ট্রিগার করছে, আমি তাকে জাস্ট কোডিফাই করছি লিপিত কবিতার মাধ্যমে। তুমি যে বলছ, কবিতা তোমাকে চয়েজ করছে, আমি সেটাকে এইভাবে বলতে চাইছি, যে কবিতা তো এসেনশিয়ালি রয়েছেই, কিন্তু চয়েজ ঠিক করছে কিনা, তার থেকে র‍্যাদার এইভাবে ভাবতে ভালো লাগে যে, সে যে তরঙ্গ ছাড়ছে, তাকে আমি রিসিভ করছি।

 

শঙ্খদীপ কর- আরেকটা কথা না বলে নিলে হারিয়ে যাবে, ওই যে বললাম না, স্পঞ্জ জল শুষছে যেভাবে, একটা টিসু পেপার সেভাবে জল শুষবে না। কারণ গণিতটাই আলাদা। ঠিক একইভাবে দুটো আলাদা রিসিভার, তুমি যেমন বললে, সেভাবেই, ধরি জল রিসিভ করছে। তুমি অনেকটা গুছিয়ে বলেছো। সেভাবেই, তুমি যেভাবে রিসিভ করছ, তুমি সেভাবে ডিকোড করছ। অন্য আরেকজন আরেকভাবে রিসিভ করে আরেকভাবে ডিকোড করছে।

 

দেবাঞ্জন দাস- আর হচ্ছে, যে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ব্যক্তিজীবন আর কবিজীবন, এই দুটো জীবন দুটো জীবনকে এফেক্ট করে। কিন্তু এটা ঘটনা, যে কবিতার ট্রিগার পয়েন্টগুলো যখন সে রিসিভ করে, এবং তার থেকে যখন সে লিপিত করে, সেই জার্নি তার একার। সেখানে কবি একাই। সেখানে তার সাথে আর কেউ থাকে না। সে চাইলেও থাকে না। না চাইলেও থাকে না। কেউ থাকতে চাইলেও পারে না।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা- আমার একটা জিনিস মনে হয়, প্রথম আর দ্বিতীয় জীবন নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। যখন, কবি লিখতে বসে, তখন কি প্রথম জীবন থাকে?

 

শঙ্খদীপ কর- সবাই কি লিখতে ওভাবে বসে? আমি অন্তত বসিনা ওভাবে। তুমি যেভাবে বলছ সেভাবে লিখতে বসাটা ব্যক্তি অনুযায়ী আলাদা। ধরো, কেউ কাগজ পেন নিয়ে বসলো। কেউ হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো। বাড়িতে এসে কেউ মোবাইলে টাইপ করলো। কিংবা গুগল ভয়েস টাইপিং। সবাই তো আলাদা ভাবে লেখে। তাহলে যখন সে লেখে, তখন তার এই দুটো জীবন একে অপরকে ওভারল্যাপ করবে না, এটা নাও হতে পারে । ধরো, বিয়েবাড়ির ভিড়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমার কাছে কবিতার দুই লাইন মাথায় আসতে পারে।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা- আমার কথাটা সেটা ছিল না। আমার কথাটা ছিল, তুমি যে মুহূর্তে ওই দুটো লাইন নিয়ে ভাবছ, সেই মুহূর্তে তোমার চারপাশ বিচ্ছিন্ন।

 

শঙ্খদীপ কর- এটাকে কি সুইচ করা বলব না? হিউম্যান বডি, প্রাথমিকভাবে, যদি একজন শিশুকে ধরি, সেই হিউম্যান বডি মাল্টিটাস্কিং এর জন্য নয়। অথচ দেখা যাচ্ছে, খেতে খেতে একজন ফোনে কথা বলছে। অথবা সাইকেল চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছি। সাইকেলের সামনে যেই কেউ চলে এলো, মোবাইলে কথা বলার মোডটা ব্রেনের ভেতরে সুইচ অফ করে সাইকেল চালানোর মোডে শিফট করে ব্রেকে হাত রাখলাম। আবার যেই সোজা রাস্তা, কেউ নেই, আবার সুইচ অন শিফট করে গেল। এই ব্যাপারটা চলছে না কি? ধরো, একটা কথা মনে পড়ে গেল এখুনি, এই যে সুইচ অফ অন, এই মুহূর্তের জন্য বিছিন্ন হয়েও আবার সে বিয়েবাড়ির আবহে ফিরে গেল।

 

দেবাঞ্জন দাস- আমার মনে হয় দুটো জায়গা আলাদা। যখন কবিতা নিয়ে তুমি কাজ করছ, তখন তুমি ক্রিয়েটিভ কাজ করছ। তখন তোমাকে আনকনশাস কে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে আসলে। তুমি যখন তোমার তরঙ্গ ল্যাঙ্গুয়েজে ডিসাইফার করছ, তখন তো আনকনশাস কে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এর ফলে ওই দুটো অস্তিত্ব, সাদা চোখে, হয়তো তার ওভারল্যাপিং সম্ভব, কিন্তু তার আলাদা অস্তিত্বও তখন নেসেসারি হয়ে পড়ে। তুমি যখন বিয়েবাড়িতে থেকে কবিতা লিখছ, বা শ্মশানে গিয়ে বসে থেকে কবিতার লাইন, এটা আমরাও করেছি, দিনের পর দিন শ্মশানে গিয়ে বসেছি, কবিতা লিখব বলেই ইচ্ছাকৃত করেছি, তখন হয়তো কবিতা আসেনি। এসেছে হয়তো দশ পনেরো দিন পর।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা- কবি যখন সাদা পাতা বা লিপিত কবিতার সামনে আসে, তখন মুহূর্তের জন্য হলেও তার প্রথম জীবনটা  অ্যাবসেন্ট হয়ে যায়।

 

উমাপদ কর- আমি এখানে বলি, আমি মনে করি, এটা রেসিপ্রোকাল। এবং সম্পূরক। দুটোই হয়। কখনো ওভারল্যাপও করে। দুটোই ঘটে।

 

স্বপন রায়- একটা প্লেয়ার যখন মাঠে নামে, তখন তার কাছে বাকি সব অফ হয়ে যায়। ক্রিয়েটিভিটিও একটা খেলা। এটাই বলছি।

 

শঙ্খদীপ কর- এটাই সেই খেলা, তা কেন্দ্র মুছে দেওয়ার খেলা হোক, কেন্দ্রে যাওয়ার হোক, কেন্দ্রজীবন হোক, কবিজীবন হোক, সবই ওভারল্যাপড। উমা দা যেমন বলল, দুটোই হয়। এখানেই তাহলে এই গ্রুপ ডিসকাশন শেষ করা হলো।





Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger