ধারামুক্ত কবিতা কতটা
ধারামুক্ত? কীভাবে ধারামুক্ত?
চিত্তরঞ্জন হীরা
খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন। সত্যিই তো আমাদের
ভেবে দেখা দরকার যে, বাংলা কবিতা এই সময়ে দাঁড়িয়ে চলতি ধারা থেকে কতটা মুক্ত হতে
পেরেছে ! আর মুক্ত যদি হয়ও, তা কীভাবে !
ইতিহাসের দিকে তাকালে একটা বিষয় অন্তত আমরা লক্ষ্য
করবো, এই হাজার বছরের বাংলা কবিতায় এক পর্ব থেকে আরেক পর্ব বা একটা ধারা থেকে
আরেকটা ধারায় পৌঁছাতে কখনও কখনও অনেকটা সময় পেরিয়ে আসতে হয়েছে। আবার কোথাও সময়টা
তুল্যমূল্যতার নিরিখে কিছুটা কম। এর সঙ্গে অবশ্য সময়বাস্তবতার একটা সংযোগ রয়েছে।
অর্থাৎ সময় যেভাবে বদলায়, সমাজ যেভাবে বদলায়, শিল্প-সাহিত্যের মধ্যেও সেই পাল্টে
যাওয়া সময়ের চিহ্নগুলো ধরা পড়ে।
সাহিত্যের ধারা একটা সময় নির্ভর করতো বিষয়ের উপর।
চর্যাপদ থেকে পদাবলি বা মঙ্গলকাব্যের দিকে তাকালেই বিষয়টা ধরা
পড়বে। পরবর্তী ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে ধারা গড়ে ওঠার পেছনে ভাষার ভূমিকা প্রধান
হয়ে উঠছে। আর রয়েছে আঙ্গিক বদলের আভাস। সাহিত্যের ইতিহাস সে অর্থে হলো ভাষাবদলের
ইতিহাস, টেকনিক বদলের ইতিহাস।
সময় এখন দ্রুত পাল্টাচ্ছে। কোনও কিছুর প্রতি খুব বেশি
টান আমাদের থাকছে না। ফলে দ্রুত মুখের ভাষা পাল্টাচ্ছে, খাদ্যরুচি পাল্টাচ্ছে,
পোষাক পাল্টাচ্ছে। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারবো না যে, এই
পরিবর্তনটা বাকি সব পরিবর্তনের সঙ্গে সমান তালে ঘটছে। পাঠকরুচির একটা ব্যাপার
আছে। মানুষ বিজ্ঞানকে যত তাড়াতাড়ি জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে গ্রহণ করে,
শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির জন্যে তার ভাবনার জগৎটা কিন্তু ততটা এগিয়ে নয়,
একটু পিছিয়েই থাকে। তাছাড়া সাহিত্য চিরকালই সীমিত জনের চর্চার বিষয়। এই যে এত এত
নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার কথা আমরা বলতে বসেছি, এর সংখ্যা কত ! হিসেব করলেই বোঝা
যাবে ঐ সীমিত সংখ্যার মধ্যে আরও সীমিত সংখ্যক লেখক-পাঠক। একমাত্র তাঁরাই স্রোতের
বিরুদ্ধে দাঁঁড়িয়ে নতুন নতুন ভাবনা বা চিন্তা প্রকাশের সাহস
দেখান।
# # #
এবার বারীনদার কথা দিয়ে শুরু করি। তিনি বলেছিলেন –
পুরোনোকে ছেড়ে দিলে কবিতার যা হয় – তা নতুন কবিতা। অর্থাৎ পুরনো কবিতার সমস্ত
চিহ্ন বর্জন করতে পারলেই কবিতা হয়ে উঠবে নতুন বা ধারামুক্ত।
তো এই নতুনের সন্ধান বা ধারামুক্তির তাগিদ কীভাবে আসে
তা নিয়ে আগেই আমরা একটা আভাস রেখেছি। খুব বেশি পেছনের দিকে না গিয়ে যদি মধুসূদনের
শুরুর সময়টাকে একটু লক্ষ্য করা যায়, তাহলে দেখবো তিনি যখন জন্মেছেন (১৮২৪ ), তার
কিছু আগে ১৭৭৮-এ বাংলায় ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই মুদ্রণ প্রযুক্তির প্রভাব
পড়লো সাহিত্য ও সমাজে। একটা নতুন বাঁক সৃষ্টি করলো। কারণ তার আগে মানুষ কানে শুনে
গান বা সুরের মাধ্যমে সাহিত্যরস আস্বাদন করতো। সাহিত্য যখন থেকে ছাপা অবস্থায় সামনে এলো, তার প্রভাবে কবিতার শব্দ সুরের নির্ভরতা
ছেড়ে পাঠ্যবস্তু হয়ে উঠলো। যতদূর লক্ষ্য করা যায়, ভারতচন্দ্রই (১৭১২ ) সুরবর্জিত স্বাভাবিক বাচনভঙ্গিতে প্রথম কবিতা লেখার
চেষ্টা করলেন। তখন থেকে দেখা যাচ্ছে বাইরের সুর একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। কবিরা
কবিতার ভেতরের সুর ও ছন্দ নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। বলা যায় অন্তর্লীন শব্দের সঙ্গীত
বেজে উঠতে লাগলো। এছাড়াও ভারতচন্দ্রের আরও কিছু ভূমিকা রয়েছে। তিনি সংস্কৃত ও
ফারসি ছন্দকে বাংলা ছন্দের সঙ্গে মিশিয়ে একটা নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁঁর
ভাষা ক্রমশ এতটাই মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি হয়ে এলো যে মুখে মুখে কবিতার অনেক
পংক্তি প্রবাদে পরিণত হলো।
তার একশ বছর পর ঈশ্বর গুপ্ত ( ১৮১২ ) এলেন। কিন্তু
তিনি যখন লিখতে এলেন দেখা যায় খাঁটি বাঙালি কথায়, বাঙালি মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে আরও বেশি সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে
ভারতচন্দ্রের প্রভাব কিছুটা হলেও আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। অবশ্য আমাদের মনে
রাখতে হবে এই সমসময়ে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও(১৮২৭) এসেছেন। তিনি অনেকটাই
চেষ্টা করেছেন প্রচলিত ধারা থেকে মুক্ত হতে। আসলে ধারা বলতে তখন ছিল কবিয়াল,
পাঁচালিকারদের আদিরসাত্মক কাব্যের প্রভাব। তিনি কবিতাকে সেই নগ্নতা থেকে মুক্ত করে
স্বাদেশিকতা বা দেশপ্রেমের দিকে উত্তরণ ঘটালেন। আর সে সময়েই শুরু হয়েছিল
আখ্যানকাব্য থেকে বেরিয়ে এসে মহাকাব্য লেখার যুগ। তবে নানা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে
কবিতায় একটা সন্ধিক্ষণ চলছিলই। এরপরই এলেন মাইকেল মধুসূদন।
বারীনদা বলেছিলেন – "মূলধারাটা তৈরি করেছিলেন
মধুসূদন। তারপর রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ তাঁদের মৌলিক নির্মাণ কৌশল দিয়ে ধারাটিকে
প্রাণবন্ত করেছিলেন"।
এর মধ্যে লুকিয়ে রইলো দীর্ঘ একটা সময়। তাকে আমরা
তিনটি পর্বে বা তিনটি কাল দিয়ে বিচার করতে পারি। অবশ্য সাহিত্যের পণ্ডিতরা সেটাই
করেছেন। তাকে আমরা ধরি মধুসূদনের কাল, রবীন্দ্রনাথের কাল ও জীবনানন্দের কাল
হিসাবে। মূলধারা বলতে বারীনদা যা বোঝাতে চেয়েছেন সেটাকে আধুনিকতার শুরুর কাল
হিসাবেও ধরা যায়। সেই সূত্র ধরেই আমরা বলতে পারি প্রথম আধুনিকতার জন্ম হয়েছিল মধুসূদনের
হাত ধরে। অর্থাৎ ১৮৬১ সাল, "মেঘনাদবধ কাব্য"। সেখানে আমরা কি দেখলাম !
পূর্ববর্তী ধর্মীয় কাঠামো বা ধর্মের মোড়কটি খসে পড়ছে। কবিতায় মানুষের কথা উঠে
আসছে। যদিও পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস অনেক আগেই বলেছিলেন –
শুনহ মানুষ ভাই।
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।।
কিন্তু আমাদের ভাববার কথা হলো, এমনটা অনুভব করার পরও
তিনি কেন যে শুধু বৈষ্ণব পদকীর্তন বা পদভজনা করে গেলেন জানিনা। হয়তো শুধু
রাজ-অনুগ্রহ পাওয়ার জন্যেই !
যাহোক আমাদের অপেক্ষা করতে হল মাইকেল পর্যন্ত। তিনিই
মানুষের শক্তি, সাহস, আশা আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, বেদনাকে সাহিত্যে মর্যাদা দিলেন।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে যে বীররসের প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম
মধুসূদনে এসে তা আরও গভীর ও পরম মাত্রা পেল। এছাড়া আমরা তাঁর নতুন ছন্দ সৃষ্টির
কথাও জানি। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো মানবতা, যুক্তিবাদ, সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।
তা চললো প্রায় ঊনিশ শতকের শেষপর্ব পর্যন্ত।
এই সময়ের মধ্যে অর্থাৎ মহাকাব্যিক যুগের গতানুগতিক
পর্বে রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েছেন। 'মানসি', 'সোনার তরী' বাংলা কবিতায় নতুন রসের
আস্বাদ দিতে শুরু করেছে। তবে সে অর্থে আধুনিকতার দ্বিতীয় জন্ম বলা যায় তাঁর
'বলাকা' কাব্যগ্রন্থ ( ১৯১৬ ) প্রকাশের পর। এই বলাকার হাত ধরেই বাংলা কবিতায় নতুন
আঙ্গিকে নতুন ভাষায় জীবনের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা মূর্ত হয়ে উঠলো। সঙ্গে এল
নিসর্গচেতনা, ঐশ্বরিক প্রেম। এল জীবনে শূন্যতাবোধের নতুন ব্যঞ্জনা। এসেছে আরও আরও
অনেক নতুন অনুষঙ্গ, যা পূর্ববর্তী ধারা থেকে মুক্ত বা বিচ্ছিন্ন।
# # #
তৃতীয় আধুনিকতার জন্ম হয় সেই রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রমের
চেষ্টার মধ্যে দিয়েই। যার শুরু ত্রিশের দশক থেকে। আমরা জানি বুদ্ধদেব বসুদের সেই
প্রচেষ্টাকে সে সময় মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না রবীন্দ্র অনুরাগীদের। কিন্তু সময়
যেমন এক জায়গায় থেমে থাকে না, তেমনি সময়ের ভাষাও একটু একটু করে বদলে যায়। কবি
লেখকদের কাজ সেই সব বদলে যাওয়া ভাষা ও প্রবণতাকে সাহিত্যে ধারণ করা। এটাই সত্য।
ইতিহাসের এই সত্যকে তো মানতে হবে।
আমরা এটাও জানি, বুদ্ধদেব বসুরা সে সময় আন্দোলনটা
শুরু করলেও নিজেরা পারেননি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হতে। পেরেছিলেন নজরুল। তারপর
জীবনানন্দ। রবীন্দ্রনাথের গড়ে তোলা ধারা এবং জীবনানন্দের গড়ে তোলা ধারার মধ্যে
ভাষাগত কোনো প্রভাব বা সংযোগ রইলো না। বাংলা কবিতা জীবনানন্দের কালে এসে বলা যায়
এক বিশ্বজনীন পরাবাস্তবতায় মূর্ত হতে লাগলো। নজরুলের ভূমিকাও কম নয়, তবুও বলা
হয় ভাঙলেন জীবনানন্দই। তৃতীয় নতুনের প্রতিষ্ঠা হলো তাঁর হাতে। কবিতায় এল অবচেতনের এক অদ্ভুত পরিসর। বিস্তৃতও হল বহুদূর। এই
কারণেই বারীনদা 'প্রাণবন্ত' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সচেতনভাবে। কারণ সজীব ছিল
বলেই এতদিন ধরে প্রাণের সঞ্চার ঘটালো।
যাহোক, এখানে বলার কথা যেটা তা হলো, মধুসূদনের
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনেকটা চাপা পড়ে গেল। তাকে সরিয়ে আমির প্রতিষ্ঠা
দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনানন্দের হাতে তারই প্রসার ঘটেছে। ভাষা পাল্টেছে।
কিন্তু ঐ যে বারীনদা বলেছেন, নিজস্ব নির্মাণ কৌশলে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ থেকে
জীবনানন্দ পর্যন্ত বাংলা কবিতা আসলে ব্যক্তির সুখ দুঃখ বেদনা আনন্দ নিয়ে
আত্মপ্রধান। আমির বহুত্ব থাকা সত্ত্বেও যা কিছুটা সংশয়ী বা বলা যায় নৈরাশ্যতাড়িতও
বটে।
এখন আমরা আবার একটা ধারামুক্তির কথা ভাবছি। সেখান
থেকে বেরিয়ে যে নতুনকে খুঁজছি তা আসলে এতদিনের প্রতিষ্ঠিত ভিত্ অবচেতনা বা
পরাবাস্তবকে অতিক্রমের চেষ্টা। করতে হবে। করতে পারলেই আমরা কেন্দ্রিকতা ছেড়ে
অতিচেতন স্তরে এসে পড়বো। বস্তু এবং বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন ধারনার দিকে যাত্রা
করতে পারবো।
কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন অতিচেতনা বলতে ঠিক কী
বোঝানো হচ্ছে ! কাকে বলে অতিচেতনা ! বারীনদা বলছেন–
"বিশ্বসংসার তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গে ভাসছে। তার একশ
ভাগের মাত্র ৬ ভাগ প্রতিফলন আমরা খোলা চোখে দেখতে পাই। মানুষের শিল্পকলা সংস্কৃতি বিস্ময় আগ্রহ ঐ ৬ ভাগে সীমিত। অতিচেতনা এই সীমা ভেঙে
দেয় ; চেতনাকে ছড়িয়ে পড়তে দেয়। ঐ যা ছিল সীমানার বাইরে, যার অস্তিত্ব টের
পাচ্ছি অসাধারণ অবাক প্রতিফলনে, তাকে extra consciousness বলা চলে। Super না,তাতে
quality বা গুণ বোঝায়।"
এখান থেকে আমাদের অতিচেতনার পরিসরটা বুঝতে শুরু করতে
হবে। অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে হবে। পুরোনো অভ্যাসকে ভাঙতে হবে। নতুন বিশ্বাসের
অবস্থানে পৌঁছাতে হবে। বস্তু ও বাস্তবতা সম্পর্কে পূর্ববর্তী ধারণার সীমানাটা
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাঙছে। আমরা হয়তো সবাই টের পাচ্ছি না। কিন্তু বারীনদা বলছেন –
"সীমানা ভাঙার ফলে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে ভাবনা ও ধারণাগুলো, যা আছে অথচ ছিল
অনলব্ধ, তার হঠাৎ ছোঁয়া দেয় সেই ভীষণ অবকাশ, যা অতিচেতনার পরিসর।"
আমরা আবার একটু পেছনের দিকে যাই। যেখানে দেখা যাচ্ছে
রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে বুদ্ধদেব বসু কতকগুলো প্রক্রিয়ার কথা বলেছিলেন।
কীভাবে লেখা হবে কবিতা।একটা নির্দেশিকার মতো। তিনি যা বলেছিলেন সেটা ভাষার
ব্যবহার, ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে। মোট কথা টেকনিক বদলের কথা। কিন্তু তলে তলে
তাঁরা প্রত্যেকে পরাবাস্তবকেই লালন করে এলেন। সত্যিকথা বলতে কি জীবনানন্দ ছাড়া আর
কেউ আলাদা ভাষায় কবিতা লিখতে পারেননি। কবি-সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যর কথা আমরা
জানি। তিনি কথাটা স্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন – "আমরা সব রবীন্দ্রনাথকে
ভাঙিয়ে খেয়েছি"। আবার দেখা যাচ্ছে কবি নীরেন্দ্রনাথও তাঁর শেষজীবনের একটি
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ( এটাই তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার ) একটি প্রশ্নে, নিজস্ব ভাষা গড়ে
তোলার প্রশ্নে, একই কথা বলছেন। বলেছেন – "রবীন্দ্রনাথ ভাঙিয়ে খাচ্ছি আমরা
সবাই। একটু এদিক-ওদিক করছি মাত্র। আমার আবার নিজের ভাষা কী !"…
তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলা কবিতার বহিরঙ্গে অর্থাৎ ভাষা
কিছু অদলবদল হলেও অন্তরাত্মায় আত্মায় আজও সেই রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ। মূলধারার
কবিতা এর মধ্যেই ঘোরা ফেরা করছে। পুরোনো এখনও আমাদের ছেড়েও
ছাড়ছে না। কিন্তু পাশাপাশি একথাও স্বীকার করতে হবে যে কেউ কেউ তা থেকে বেরিয়ে আসার
চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এবং এটাই ঘটে। মূলধারার পাশাপাশি সবকালেই ধারামুক্তির নিভৃত প্রয়াস চলতে থাকে। গোপনে এই ভাঙার কাজ কেউ কেউ আপন মনে করে যান। আমাদের এখনকার খোঁজ
সেখানেই। এই ধারাবিরুদ্ধতাকে কেউ বলেন ঐতিহ্যছুট, কেউ বলেন এটা তৃতীয়ধারা।
তৃতীয়ধারা মানে ! এই প্রসঙ্গেও আমরা কিছুটা আলোচনা
করতেই পারি। বলা হচ্ছে প্রথম দুটি ধারা মিলে মূলধারা। একটি হলো ঐতিহ্য, যা চলছে,
দ্বিতীয়টি ঐতিহ্যের বিস্তার, এটাও চলছে। ঐ মৌলিক নির্মাণ কৌশল দিয়ে যেমন আমরা কোনও
কোনও কবিকে ধারার মধ্যে থেকেও আলাদা করতে চেষ্টা করে থাকি তা হল স্বকীয় বিস্তারের
কারণে। কিন্তু বিস্তারটা হচ্ছে কোথা থেকে ! তৃতীয়ধারা থেকে। সেখান থেকে নতুন নতুন
সম্ভাবনাগুলো তুলে নিয়ে ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটছে। অনেকেই মানতে চাননা, এই যে নতুন
কয়েনেজগুলো তাঁদের কবিতায় ঢুকছে, এগুলো আসছে কোথা থেকে ! গ্রাহ্যতা বা মান্যতা
দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা ভীষণ হীনমন্য। তাতে অবশ্য কবিতার কিচ্ছু এসে যায় না। চলা
তো থেমে থাকে না।
যাহোক ত্রিশের দশকের আধুনিক আন্দোলনের পর চল্লিশে আসে
সাম্যবাদী, ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনগুলো। কবিতার বাঁকবদলে, বা কখনও কখনও
ভাষাবদলের কিছুটা হলেও এতে সাহায্য হয়েছে। আমরা যদি প্রতিকবিতার কথা ধরি তা মূলত
চল্লিশের দশকেই। এর কিছুটা পর উল্লেখযোগ্য হল ষাটের দশকের কয়েকটি আন্দোলন। যেমন
হাংরি, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, ধ্বংসকালীন ইত্যাদি। আরও আরও ছোট খাটো আন্দোলন
হয়েছে। কিন্তু বলার কথা হল এই সমস্ত আন্দোলনের এক একটা ম্যানিফেস্টো ছিল। যার
মাধ্যমে কবিতায় বা গল্প-উপন্যাসে ধারাবদলের কথাই তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন। তখন
প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে নতুনের সন্ধানই করতে চেয়েছিলন। তবে সে অর্থে পুরোনোকে
একেবারে বর্জন করে নতুনের কথা ছিল না। আশির দশকে এসে বারীনদা সোচ্চার হলেন এই
জায়গাটায়। একেবারে নতুন। সব পুরোনোকে বর্জন করলেই নতুনে আসা সম্ভব।
এক্ষেত্রে আমরা নতুনের জার্নিটা জীবনানন্দ পরবর্তী
সময় থেকে যদি ধরি বা আধুনিকতার চতুর্থ ফেজ হিসাবে যদি ধরি তাহলে লক্ষ্য করবো
অনেকগুলো প্রবণতার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে কবিতার ধারামুক্তি ঘটছে। সেখানে পুরনো
প্রবণতার সঙ্গে নতুনের মাত্রাটাও আমরা লক্ষ্য করতে পারবো। যেমন–
১. প্রচলিত বা নিরূপিত ছন্দকে
বর্জন করে শব্দ মধ্যস্থিত ধ্বনিমাধুর্যের সাহায্যে নতুন কোনো ছন্দের আবহ তৈরি করে
ফেলা। যেখানে অন্ত্যমিল, মধ্যমিল ইত্যাদির কোনো সম্পর্ক নেই।
২. বস্তুর গুণগত অবস্থান
পাল্টে বাস্তবের নতুন ধারনার জন্ম দেওয়া। যেহেতু বস্তুকে আমরা চিনি কয়েকটি চিহ্ন
বা ধ্বনির মাধ্যমে। চিহ্নগুলো বদলে দিলে বস্তু সম্পর্কে ধারনার বদল হয়। আবার নতুন
নতুন দৃশ্যবোধের জন্ম হতে পারে।
৩. শব্দের নির্দিষ্ট কোনও অর্থ নেই বলে কবিতাও
নির্দিষ্ট কোনও অর্থে কখনও পৌঁছাতে পারে না, শুধু অনুভূতির কাছেই তার সাড়া।
কবিতায় এই অনুভূতিকেই আরও বেশি সজাগ করে তোলার চেষ্টা।
৪. শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টির
জন্যে কখনও কখনও শব্দজোট বা শব্দসমবায় গড়ে তোলার চেষ্টা।
৫. টানাগদ্যে ভাষার পুনর্গঠন। যেখানে শব্দই তার
প্রধান আশ্রয়। পরাবাস্তব থেকে বেরিয়ে কাল্পনিক বাস্তবতাকেই বাস্তব করে তোলার
চেষ্টা। অর্থাৎ কবি যা দেখেন সেটাই বাস্তব। অনর্থ কোনো বস্তু বা বিষয়ের আশ্রয়ে
তাঁর দেখাকে আর প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না।
৬. বিষয়কেন্দ্রকে বর্জন করে বহু বহু বিষয়ের সংঘটনে
কবিতা হয়ে উঠছে বহুরৈখিক। এভাবেই কবিতার ভেতরের
ব্যঞ্জনাকে বহুমাত্রিক করে তোলার চেষ্টা।
৭. কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা পরম্পরা আর কবিতায়
সেভাবে থাকছে না। পুরোনো বা প্রচলিত যুক্তিশৃঙ্খলকে ভেঙে নতুন যুক্তি বা
অনির্ণেয়র দিকে ভাবনা কে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
৮. কবিতা ও বিজ্ঞান যখন পাশাপাশি চলতে থাকে তখন
পারস্পরিক লেনদেনও শুরু হয়। শুধু অনুষঙ্গে বিজ্ঞানের ভাষা ব্যবহার নয়, কবিতার
চেতনকাঠামোয় সেই আলোড়নকে ধারণ করতে হবে, অর্থাৎ বিজ্ঞানচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া।
৯. উপমা, প্রতীক, রূপকের বর্জন। শব্দরা শুধুমাত্র
এক্সপ্রেশনেই চিনিয়ে দেবে কবিতার নতুন বিশ্বকে।
১০. আবেগের প্রাধান্য বর্জন। আবেগকে যুক্তি দিয়ে
বিশ্লেষণ করে তার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা।
১১. সঙ্গীতময় প্রেমের কবিতাকে উপেক্ষা করা। কবিতায় গান উঠবে ধ্বনি থেকে। ফলে কবিতা হবে
ইনস্ট্রুমেন্টাল, মিউজিকাল। অর্থাৎ কোনও কবিতা পাঠের পর ভেতরে যদি বেজে ওঠে, সেটাই
তার বাদ্যধ্বনি।
১২. কবিতায় কোনও দৃশ্য আর অন্য দৃশ্যকে রেফার করে না।
ফলে সাদৃশ্যবাচক শব্দের আর বিশেষ প্রয়োজন থাকছে না। প্রতিটি দৃশ্যই স্বয়ম্ভু। কবি
যা দেখেছেন আর যা দেখাতে চাইছেন তার মধ্যেই বাস্তব।
১৩. একটি উজ্জ্বল পংক্তির চেয়ে টোটাল কবিতা লেখার
চেষ্টা।
১৪. কবিতায় গল্প বা নাটকের আর কোনও জায়গা নেই।
১৫. শ্লেষ বা বিদ্রূপ সামাজিক ঘটনার প্রেক্ষিত থেকে
উঠে এলেও সরাসরি সে কোনও অভিঘাত দেয় না। ফলে শ্লেষের অভিব্যক্তিও রচিত হচ্ছে নতুন
ভাষায়।
১৬. প্রতিকবিতা বা অ্যান্টিপোয়েট্রির কনসেপ্টও পাল্টে
গেছে অনেকটা। যেহেতু ভাষাচরিত্র বদলে যাচ্ছে, সেই কারণে এই বদলগুলোও সচেতনভাবে
লক্ষ্য করার বিষয়।
এভাবে আরও আরও লক্ষণ হয়তো চিহ্নিত করা যায়, তবে
বারীনদা নতুন কবিতার নতুন পরিসর গড়তে গিয়ে পরিবর্তনগুলো যেভাবে দেখেছেন বা
দেখিয়েছেন, সেটা একটু আমরা দেখি। বলছেন–
১. শব্দ সৃষ্টির গোড়াকার ধ্বনিসংকেত উদ্ধার ও ব্যবহার
কৌশল হবে নতুন কবিতা গঠনের মূল সূত্র। কারণ শব্দ একটা প্রতীক মাত্র, যার নির্দিষ্ট
কোনও অর্থ নেই। ফলে শব্দ দিয়ে গড়ে তোলা কবিতারও কোনও মানে হয় না।
২. কবিতার কোনও মূর্তি নেই, প্রতিমা হয় না, তা
বিমূর্ত, নিরাকার, তাই বিষয়হীন।
৩. আমরা কবিতা লিখি না,
কবিতালিপি তৈরি করি। গানের জন্যে যেমন স্বরলিপি। সুর কিন্তু অদৃশ্য। তেমনি কবিতার
শব্দ এবং পংক্তির মধ্যে অদৃশ্য অনেক কিছু থেকে যায়, যা কখনও বোঝা যায় না, যার ব্যাখ্যা
হয় না। শুধু অনুভব করতে হয়……, যা পড়া বা শোনার পর, সেই শব্দধ্বনি থেকে আলো বর্ণ রস
মিলে এক একটা ছবি তৈরি হয়, যা পাঠকের মনে অর্থাৎ মানসলোকে অনুভবে সাড়া দেয়। এই
অনুভব থেকে পাঠক যা উদ্ধার করবেন সেটা পাঠকের নিজের কবিতা, কবির বা স্রষ্টার নয়।
৪. পৃথিবীর যাবতীয় কেঅস বা বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকে ফাজি
লজিক সৃষ্টি করতে হবে। এই বিশৃঙ্খলা বা অবিন্যাসকে শব্দে ধরতে হবে নিজস্ব
যৌক্তিকতা দিয়ে, বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে।
আমাদের ইন্দ্রিয় সবসময় কিছু না কিছু তথ্য বাইরে থেকে
সংগ্রহ করে চলেছে, মাথার ভেতর জমা করছে, তাদের
এক একটা প্রতিক্রিয়া আছে। যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে তার সমান্তরাল
বা সমানুপাতিক বা সামঞ্জস্যের খোঁজে মন সবসময় ছুটছে। নানাভাবে ছুটছে। সে যখনই বাধা
পাচ্ছে ভেতরে একটা কেঅস তৈরি হচ্ছে। সরাসরি
কয়েকটা শব্দে সমস্ত অবিন্যাসটি কবি ধরেন, নিয়ন্ত্রণ করেন পাঠকের মনকে ছুটিয়ে, এটাই
কবির কাজ। যেহেতু কবিতা সরাসরি বলা যায় না এবং আপাত কবিতাটার ভেতরে রয়েছে অনেক
কবিতা, সেই সব স্পর্শের কাছে পাঠককে নিয়ে যেতে চান কবি।
৫. শব্দসৃষ্টির আদিতে যে ধ্বনি তার সংকেত উদ্ধার ও
তাকে ব্যবহারের কৌশল।এখান থেকেই নতুন কবিতা গঠনের শুরু। এতে নতুন শব্দ তৈরির
প্রবণতা যেমন থাকছে, শব্দের নতুন ব্যবহারও লক্ষ্য করার বিষয়।
৬. দৃশ্য ও বোধের জায়গাবদল, সাবজেক্ট ও অবজেক্টের
জায়গা বদল। এ থেকে যে ধ্বনির আবহ তৈরি হয় সেটা নিয়ন্ত্রিত হলে পাঠকের মনে এক
অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। এই জায়গাবদল বা জাক্সটাপোজিশন ভাষার নতুন বিন্যাসকে প্ররোচিত
করে।
৭. এরপর আসছে বিষয়হীনতার কথা। আগে বুঝতে হবে যেকোনও
সম্ভাবনাই বাস্তব। আর সংঘটিত যা কিছু সব অবাস্তব। এটাই কবির সত্য। এক্ষেত্রে কবিতা
আর নির্দিষ্ট কোনও বিষয় বহন করে না। যেকোনও ভাবনার শুরুতে একটা বিষয় থাকে। সেটা
ভাবনার কেন্দ্র। কবিতার মধ্যে থেকে কেন্দ্রটিকে চ্যুত করা হয়, কেন্দ্র থেকে
বেরিয়ে গিয়ে। কেন্দ্রটি হারিয়ে যায়। এভাবে বিষয়কে বাতিল করা যায়। অনেক ভাবনা
থাকলেও তা ওপেন এণ্ডেড। আর বিষয়ে ফিরে আসার প্রবণতা থাকছে না। এটা হল কেন্দ্রাতিগ
চলন। অবজেক্ট থেকে সাবজেক্টে যাওয়া হচ্ছে। আগে ছিল কেন্দ্রাভিগ চলন। তখন সাবজেক্ট
থেকে অবজেক্টে যাওয়া হত।
যাহোক যা বলছিলাম, আমাদের নজরে পড়ছে, এখন যেটা মূলধারা, তার মধ্যে অনেক অনেক শব্দের ব্যবহার, অনেক অনেক নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি হচ্ছে যা অতিচেতনা থেকেই পাওয়া। একদিন বাংলা কবিতা নিশ্চয়ই নতুনের হাত ধরে জীবনানন্দ প্রভাবমুক্ত হবে, এটুকু আশা আমরা রাখতেই পারি। কারণ ভাষাও এক প্রগতিশীল বিজ্ঞান। তার তো থেমে থাকা চলে না। যাঁরা ক্রমাগত গতানুগতিক কবিতার চর্চা করে যাচ্ছেন এবং তাকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তার স্থায়ীত্ব নিয়ে সংশয় চিরকালই থাকে। এই নিয়ে বিচলিত হওয়ারও কিছু নেই, হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। নতুনের কাজ নতুন করবে, আরও নতুনের দিকে হেঁটে যাবে। এটাই তার নিয়তি। আমরা সেই অপেক্ষায় রইলাম…।
Post a Comment