সুত্র ধরলেন উমাপদ কর
এবার আমি অরবিন্দ রায় কে কবিতা পড়তে
বলবো। অরবিন্দ গ্রামের ছেলে এবং স্বভাবগতভাবে খুব লাজুক। কবিতায় গ্রাম্য শব্দ
ব্যবহার করে। ধীরে ধীরে ও নিজের মতো করে কবিতা লিখবার চেষ্টা করছে
এবং গত দু'বছর ধরে সেই প্রসেসটার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই।
আমি প্রথমেই যেটা বলতে চাই সেটা হল, ও একটা চেষ্টার মধ্যে আছে ওর এই
চেষ্টাটাকে আমরা (গাইড শব্দটা আমি ব্যবহার করবো না) কতটুকু সাধুবাদ জানাতে পারি, কতটুকু তাকে সতর্ক করতে পারি, কতটুকু আমরা তার পাশে দাঁড়াতে পারি, তার ভাবনা চিন্তা বা প্রকরণ বা শৈলী বা কবিতার ভাষা
ইত্যাদি নিয়ে, সেটাই আমরা চেষ্টা করবো। এটা ওর পক্ষে খুব জরুরি। এবং এই ক্যাম্পের
এটাও কিন্তু একটা বড় দিক। আমি অরবিন্দকে কবিতা পড়তে
বলছি।
অরবিন্দ রায়ের কবিতা
১.
ভ্রমণের শেষ দাড়ি টেনেছে
অচেনা একটা পথ ঘুমিয়ে
লাইনের সমান্তরাল ট্রেন নিয়ে আসে
চেনা মেয়েটার কথা মনে পড়ে
একদিন হাওয়াই দুলছিল
লেডিস যেন কামরা বরাবর দোলানো বিনুনি
ট্রেন আর স্টেশনের দূরত্বে সবুজ ধরা দেয়।
২.
দূরত্ব ছুটতে ছুটতে স্টেশন ধরা পড়ায়
লাল রঙ তুমি ডেকে সিগন্যাল।
হাতের আকর্ষণে সমান্তরাল হাটে
পথ তুমি দূরত্ব করোনা
প্রতিবিম্বও ছায়ার রূপ
বাড়ানো আত্মার কাপড় উলঙ্গ রাজা
৩.
সতীনের ছোঁয়ায় ব্যঞ্জন ঘর
বৌমার আড়ালে চৌকাঠ আঁচল
ওখানে উঠোনে ঝোলানো লেবু লঙ্কা
গঙ্গাজল ছেটানোর সন্ধ্যা প্রথা
ভাবনায় শঙ্খ বাজিয়ে চুপ কথা
আর ঠেকানো দরজায় প্রদীপ শান্ত
সন্ধ্যার কাজল প্রদীপের পোড়া মুখ
৪.
মৃত্যু রং হলুদ খসে পড়ায়
পাতা হারা গাছের ডালে জন্ম লেগে আছে
গাছ ফল পারেনা তাই কলম বাঁধা
কাঠ খুলে আসবাব সংসারের ছাদ
কার্নিশ ঝোলানো বারান্দায় ঝুল জালে
কালো একটা বিড়াল রাস্তা কেটে যায়
৫.
খিদে আর পেটের দূরত্ব বরাবর চাঁদ স্বপ্ন
আর ঋষিকেশ আলসার নিয়ে পাশে বসে
ভাতের গন্ধ শুঁকে ডাল পাতা হারায়
কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া রোদ
গ এর নরম পীঠ চাপড়ে সুকতলার ঘাম
বাঁকা মেরুদন্ডে পদ্ম আঁকছে বীজের ঠেলাগাড়ি।
৬.
বিভীষিকার মৃত্যুতে মরীচিকা বাস্তব
জাতি ধর্মে রুপান্তরের দেহত্যাগ
এখানে মাস্তল বজায় থাকে প্রবাহের জন্য
নৌকার পাল চিরে বেঁচে যায় ঢেউ
ক্ষণিকের জন্য ভাবা অনুগামী
ঈশ্বর যাযাবর
###
উমাপদ কর
আমি দেবাঞ্জন কে বলব অরবিন্দর কবিতা শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া জানাতে। দেবাঞ্জন দাস।
দেবাঞ্জন দাস
ওর যে লেখা গুলো শুনলাম, মূলত যে গুলো শ্রী সিরিজ ও পড়ল তার মধ্যে আমার সব থেকে ভাল লাগল যে লেখাটা সেটা হচ্ছে যে যেটা ও দ্বিতীয় বার পড়ল যেখানে পদ্মবীজের প্রসঙ্গ রয়েছে। আমার ওই লেখাটা ভীষন ভাল লেগেছে ইনফ্যাক্ট ওই এনটায়ার সিরিজের সবথেকে ভাললাগা লেখা আমার ওটা তার কারণ হচ্ছে যে দেখুন মানে সে লেখাটাতে যে খন্ড খন্ড খন্ড খন্ড কনসেপ্ট গুলো তৈরি করে সেই কনসেপ্ট গুলোকে ও স্ট্রেস দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি। ওর বাকি সিরিজের অন্য লেখা গুলোতে ওর একটা কনভারসেশন মোডে যাওয়ার প্রবণতা আছে। সেটা ভাল্লাগে শুনতে ভাল্লাগে। কিন্তু কনভারসেশন মোডে যাওয়ার যখন একটা প্রবণতা আছে তখন সেটা ডাইরেক্ট স্যালুটেশনে যায়। এবং ডাইরেক্ট স্যালুটেশনে গিয়ে রিপিট করায়। সেই রিপিট টা শুনতে ভাল লাগে না।
উমাপদ কর
"জানো শ্রী"?
দেবাঞ্জন দাস
জানো তে অসুবিধা নেই। ও আগের লাইনটাকে রিপিট করাচ্ছে দিয়ে স্ট্রেস দিচ্ছে।
এই স্ট্রেস দেওয়া টা ভাল্লাগছে না। ওর কবিতা ও লিখবে সেটা
একশবারই এবং এগুলো ওর প্রবণতা আর কি!
জয়দীপ মৈত্র
আগের লাইনটা রিপিট করাচ্ছে বলতে?
দেবাঞ্জন দাস
আগের লাইনের কোনও একটা শব্দকে বা কনসেপ্টকে যেমন "জানো" "শোনো" বলে রিপিট করাচ্ছে পরে। ও স্ট্রেস দিচ্ছে শ্রী তে একচুয়ালি। এবার এই স্ট্রেস দেওয়াটা এত প্রমিনেন্ট হয়ে উঠছে সেটা কবিতাকে না দুটো ভাগে ভাগ করে দিচ্ছে একচুয়ালি।
সিরিজের ওই একটা লেখা তে এই প্রবণতা টা নেই। দেখুন বাকিটা তো কবি নিজের মত
করে লিখবে। আমার শুনে মনে হয় আমি এই দুটো ডিফারেন্স ওকে নোট করতে বলব। পাঠক হিসাবে
এইটা আমি পেলাম আর কি। এটুকুই বলার।
স্বপন রায়
যাক ও প্রেমের কবিতা লিখছে এটা ভালো লাগলো। কী সুন্দর সব লাইন।
চিত্তরঞ্জন হীরা
ওই যে বাকলছাড়া না কি! আর ওর প্রথম লাইনে আছে -
"পাতাহারা গাছের ডালে জন্ম লেগে আছে "
স্বপন রায়
কত সুন্দর সুন্দর লাইন। প্রেমে পড়েছে বোধ হয় ও।
চিত্তরঞ্জন হীরা
ও যতগুলো কবিতা পড়েছে তার মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি ওই কবিতাটার
মধ্যে ওই যে বাকল কি যেন -... "পাতাহারা গাছের ডালে
জন্ম লেগে আছে "
স্বপন রায়
যে প্রেমে পড়েছে সেই এটা লিখতে পারে। গুড গুড। "বাকল পারে না" - এটা কিন্তু রেয়ার ইউজ। ও-ই হয়ত প্রথম করল। "বাকল পারা" - এটা ওর আবিষ্কার।
দেবাঞ্জন দাস
এটা উমাদা ঠিক কথা বলেছে প্রথমেই যখন ওর ইন্ট্রো দিচ্ছিল, যে ও একচুয়ালি…
যে 'অনাগরিক' শব্দটা ব্যবহার করেছেন উমাদা। কবিতায় প্রচুর অনাগরিক শব্দের ব্যবহার
রয়েছে।
স্বপন রায়
ওর কবিতার মধ্যে "গ্রামীন" শব্দ আছে বললে যেটা উমা বলেছে তাতে একটা প্রিকনসেপ্ট তৈরি হয়। একটা
মাইন্ড সেট হয়ে যায়।
চিত্তরঞ্জন হীরা
ওটা আর বলবে না (হাসি)
উমাপদ কর
কেন, এটাতে কি একটা নতুন ডাইমেনশন তৈরি হচ্ছে না?
স্বপন রায়
আমার খুব ভাল্লেগেছে ওর কবিতা।
মনোজ দে
আমার মনে হচ্ছে যে ক্রিয়াপদ টা শেষে দেওয়ার জন্য বুনন টা ঠিকমত হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে ওখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেমন-"বাকল ছেড়ে যাচ্ছে" "ছেড়ে যাচ্ছে বাকল" দিলে কি ওটার সাথে একটা
রিলেট করা যেত। হচ্ছে, যাচ্ছে, প্রত্যেকটা ক্রিয়াপদ শেষে চলে আসছে, ফলে মনে হচ্ছে
যে স্টেটমেন্ট ধরনের হয়ে যাচ্ছে আর কি।
সজল দাস
নন লিরিক্যাল তাই বলছ?
স্বপন রায়
প্রোজেইক হয়ে যাচ্ছে আর কি!
চিত্তরঞ্জন হীরা
সমাপিকা ক্রিয়াপদ ইটসেল্ফ নিজেই একটা মাধুর্য তৈরি করে কবিতায়। কবি কীভাবে
সেই ক্রিয়াপদ টিকে ব্যবহার করছে। এটা একটা প্র্যাক্টিসের ব্যাপার আছে। ক্রিয়াপদ
নিজেই জায়গা তৈরি করে নেবে। সেটা অনেক সময় লাগে, অনেক সময় লাগে না।
দেবাঞ্জন দাস
ক্রিয়াপদ দিয়ে তুমি শেষ করবে কিনা সেটা অন্য গল্প। সেটা অ্যাকচুয়ালি ফ্লো
কন্টিনিউ করার জন্য করা হয়৷
স্বপন রায়
কিছু সেলফ ইমপোজড এক্সারসাইজ করা উচিত। যেগুলো কোথাও ছাপতে দেওয়ার দরকার নাই। আমি আমার অভিজ্ঞতা টা বলতে পারি। যেমন কোনও ক্রিয়াপদ ব্যবহার করব না। তাতে কি হয় অনেক সংযম চলে আসে। "আমি" "তুমি" এই শব্দ গুলো ব্যবহার করব কিনা। এতে কি হয় যখন ওয়ার্ড কনস্ট্রাকশন হয় না তখন আদার ওয়েজ খুলে যায়। "আমি" "তুমি" "সে" "ভাল" "মন্দ" বা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করছি না। কিন্তু একটা ফিলিং কে এক্সপ্রেস করছি। তখন ওই নতুন শব্দ চলে আসে, নতুন ভাবনা চলে আসে, নতুন কিভাবে সংযোগ করা যায় এগুলো চলে আসে। এবং এগুলো টেকনিক্যাল আর কি! এগুলো নিয়ে কিছু বলার নাই। এবং আলটিমেটলি একজন কবিকে অনুভব দিয়ে চেনা যায় এবং তোর মধ্যে সেটা আছে।
Post a Comment