Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।


রোয়াকে
কবিতা পড়লেন শঙ্খদীপ কর
আলোচনা করলেন চিত্তরঞ্জন হীরা, দেবাঞ্জন দাস, স্বপন রায়  

সূত্র ধরলেন উমাপদ কর

এবার কবিতা পড়বে শঙ্খদীপ কর।  শঙ্খ ওর সামাজিক জীবনে নানা ক্ষেত্রে যুক্ত, ফলত ও ভীষন ব্যস্ত থাকে, কিন্তু কবিতাটা নিয়ে উপযুক্ত চর্চা ও করে। 

 

মাঝে দেড় বছর কিছু লেখেনি, বইটা বেরোনোর পর ও আর কিছু লেখেনি। এবং এটার জন্য প্রচুর গঞ্জনা আমার কাছ থেকে পেয়েছে। অনেকবার আমাদের কথা হয়েছে এবং বারবারই ও বলেছে,  যে নতুন কিছু পারছিনা।  আসলে একটা ডিপারচার খুঁজছিল। ওই পুরোনো বইয়ের জ্যঁরটার মধ্যে আর থাকতে চাইছিল না। 

 

ও কিন্তু স্বভাবগতভাবে আবহমান বাংলা কবিতা প্রথম থেকেই লেখেনি। অন্ততপক্ষে আমার সঙ্গে যতগুলো সিটিং হয়েছে এবং যে সমস্ত কবিতাপত্র ও পড়েছে তাতে দেখেছি, আবহমান বাংলা কবিতা শঙ্খ লেখেনি। শুধু ও নয়,এরা কেউই সেভাবে আবহমান কবিতা লেখেনি। এদের প্রত্যেকেরই একটা আলাদা ধরন আছে। 

 

শঙ্খ যে এই দেড় বছর লিখল না, এই গ্যাপটা নিল, দিয়ে পরবর্তীকালে যে কবিতাগুলো ও লিখলো, (যার অধিকাংশই আমার পড়া এবং আমিই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি) আমার মনে হয় যেটা ও চাইছিল, যে আগের জ্যঁর থেকে বেরিয়ে আসতে, সেই লিফটটা ও করতে পেরেছে। বাকিটা ওর কবিতা পড়বার পর স্বপন, দেবাঞ্জন, চিত্ত বলবে। এখন কবিতা পড়বে শঙ্খদীপ কর। 

 

শঙ্খদীপ করের কবিতা

১.

বিষন্ন

অংশত ঝড় এবং কোলাহল

ক্রমে বিষন্ন

 

কিভাবে খোলে তৃতীয় চোখ

পুড়ে যায় কামনা

সে অবকাশ 

পূর্ণ অবকাশ

ছাই মেখে জেগে ওঠা

 

আজ    বেশ ভালো  

ভিখিরিকে ফিরিয়ে আফশোস নেই 

ডাকতে চাওয়া নেই

              

এইতো একা

একা বলা

প্রশ্ন করা অথবা নীরব 

 

নীরব অথবা প্রশ্নহীন 

 

২.

কিছু নিয়ে আসার ছিল

কিছু কি আনা-র ছিল

খাটের নিচে

বহুদিনের সারেঙ্গী

বহুদিনের 

 

মৌন চলে গিয়েছিলে

 

আশেপাশের কথা

প্রিয় পোষ্য

জড়িয়ে রাখছে

 

ক্লান্ত প্রশ্ন

অকারণ শীতলতা 

আর তৃতীয় ধাপে আত্মহত্যা

 

শুয়োপোকা ঘর

দুই অঙ্কের বিছানাও

 

নরম

এখনও পর্যন্ত ভোর

দূরে দেওয়াল ও পরিজনেরা

 

একটা স্মৃতিস্তম্ভ

পাশে তিনটি  ছায়া

পরিবার 

নিরুত্তর পরিবার

 

৩.

স্বর

অন্যস্বর 

চাষ নেই

শুধু পরিযায়ী অনুতাপ 

 

গ্রামোফোনে সংবিধান বাজছে 

এই আমাদের আবাদঘর 

আত্মসমর্পণ 

 

লোকটা পৃথিবী বিক্রি করে 

পারদের পৃথিবী 

খুলে রাখা কলকব্জায় তেল দেয় 

সামান্য আলাপন

সামান্য সংকোচ 

এই ভালোটুকু নিয়ে গেলে ভালো হতো 

 

কারখানার সামনে শান্ত কারখানা 

স্বর

মৃদুস্বর 

 

মৃদুস্বর অসংলগ্ন

 

৪.

অবিন্যস্ত জানলা

আমাদের মেধাবী বিবাহবিচ্ছেদ

পুড়ে যাওয়া এই বিকেলে

নিখুঁত কথাজল আর তুমি 

 

অপেক্ষা কেন করি 

এই কেন-র কোনও সুনিশ্চিত নেই

 

মৃত্যুদৃশ্যে

একটা বাচ্চা ছুটে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে 

এই সমে তুমি গান

যদিও আলাদা অনুচ্ছেদ নেই

 

আমাদের সেই বিকেল   

মুঠো ভর্তি সজনেফুল

মুঠো ভর্তি আলপিন 

 

৫.

আমি কমে আসছি 

অস্পষ্ট খোলস ক্রমশ 

অবশ্য দুঃখ প্রকাশ সে কথা বলে না 

 

সংক্রামক মুখোশ নেই তাই 

নেমপ্লেটে গান লিখেছিল কেউ 

বিশেষ করে তখন জল এসেছিল 

 

কমে আসছি 

এটা হয়তো কঠিন 

কিন্তু গলা খুলে রাখবার আগে 

চেষ্টা করেও মাতৃবিয়োগে পৌঁছানো যায়নি  

 

বিশ্বাস ব্যবহার করা হচ্ছিল রুটির পরিবর্তে 

স্কুল থেকে এল সে 

আশ্চর্য

কি শান্ত 

দুর্গম গ্রীষ্ম আর শরীর জুড়ে ছেলেবেলা 

 

ছেলেবেলা 

আংশিক মেঘলা

 

৬.

নদী দিয়ে তৈরি হবে শহর 

প্রয়োজনীয় চাকা ও বারান্দা 

বয়ে আনছে বুড়ো চাষী 

 

এখন আলোচনার মাধ্যমে 

লিখে ফেলা হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন 

যে আমি দেখতে পাচ্ছি 

যথেচ্ছ সমতল বলে 

আড়াল হয়ে যাবে অনেকসময় 

 

এই জারণমুখি জল 

এই সান্দ্র দ্বীপপুঞ্জে 

আমরা প্রায়শই সবিরাম 

অথবা দুশো বছর পর হঠাৎ উর্বর

 

মানুষের প্রধান জীবিকা হয়তো আর্তনাদ 

অযথা ক্ষয়প্রবণ 

 

সাধারণ চিনে নেওয়ার মধ্যে 

লুকিয়ে থাকে ভুলে ভরা নদী 

আমাদের চামড়ার স্থাপত্য

 

৭.

খাম থেকে এই অন্য পেনসিল 

নীল ভেঙে মা

ঘড়ি নেই বলেই দেরি হল 

এমন নয়

 

মেঘলা আঙুল 

মৃদ্যু অপেক্ষাবন

মেয়েটি কী দোষ করেছে 

 

প্রাচীরের গায়ে গায়ে হারানো বিয়োগফল 

ফাটলে অপর এসে জমে

 

ততক্ষণ খাবার গরম করা হোক

সহজ এবং বৈধ অনুমান 

মাটির রং অভ্যাসের রং কোন শিবিরে 

 

মেয়েটিই কি দোষ করেছে

জায়গাটি কল্পনাপ্রসূত 

সামনে  সংখ্যাগরিষ্ঠ

হাতে সুস্বাদু পুরনো চোট 

 

৮.

অবিলম্বে প্রতিশোধ রাখো প্লেটে 

সামান্য নুন লঙ্কাকুচি স্যালাড যোগে 

 

শ্মশান থেকে ফিরে ক্লান্ত লাগছে 

মনে হচ্ছে খিদে নামিয়ে রাখলে মেঘ করবে খুব 

সুতরাং যেতে হবে 

 

জানলা নেমে আসছে কাছে 

অসম্ভবের এই বিকেল দূরের সমতল 

 

এ পর্যন্ত পিচ্ছিল 

বাকিটা আমাদের শুকনো সাবান 

উষ্ণ অভাবে গড়িয়ে যাচ্ছে জল

 

৯.

পালক থিতিয়ে পড়ছে 

যা কিছু নাতিশীতোষ্ণ কিংবা নাগরিক 

ঢেউ ভাঙছে আলগোছে 

 

কিছুই হয়নি 

কেন হল না 

ফিরে আসছো নরম 

একটা বাঁশি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেজে উঠছে

 

পাহাড়ের নিচে ঠান্ডা 

এতে রং এবং অল্পজল ভালো হয় 

 

মুচলেকা খচখচ করছে 

এমন জলাশয় 

শুধু কাদামাটি 

আর পুরোনো যানজট 

 

আয়োজন পরিপাটি 

বিভিন্ন দিয়ে সাজানো 

কিছুতেই বেজে উঠছো না 

ছোট ছোট জ্বর

 

ছোট ছোট জ্বর সারা বাড়ি জুড়ে

 

১০.

লম্ব বরাবর সাজানো শরীর 

সাদা চাদর 

 

একটু পরেই শান্তিবার্তা পড়া হবে 

সারি সারি জানলা বিছিয়ে দেবে কেউ 

স্মৃতিফলক সমিতির পক্ষ থেকে 

জলের গোলক আনা হবে 

 

চাবিকল নিষ্প্রয়োজন 

বিস্তীর্ণ চারাগাছ পুঁতে রাখি 

অবিলম্বে রজনী 

 

চটচটে হাড়ি পেরিয়ে ঈশ্বর উড়ছেন

 

১১.

সম্ভাবনার বিষয় এখন ফেব্রুয়ারি

জিভ হোক বা নিমপাতা 

আড়ম্বরের কোনও প্লেট এখানে নেই 

শীতকাল শেষ 

ছোট হয়ে আসা বাচ্চার সোয়েটার 

বস্তির দিকে 

 

 

জল শেষ অক্সিজেন কমে আসছে 

আগুন জ্বালানোর জন্য যা যা প্রয়োজন 

তার নিদারুণ অভাব 

একটা নতুন শরীর 

এখানে কাজে আসতে পারে 

কিংবা কবোষ্ণ  রুটি 

 

তালগাছহীন পৃথিবী 

এসো কাঠের বাবুই বানাই

কাঠের বাসা

 

উমাপদ কর

চিত্ত বল।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

অসম্ভব মিষ্টি ব্যবহার শব্দের। অসম্ভব শব্দটাকে এবার আলাদা করে বলি, ব্যবহারের অসম্ভবতা শব্দের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। যেটা আমাকে ভীষণ টেনেছে। অনেক অনেক শব্দ রয়েছে, যেমন "অবিন্যস্ত জানলা" দেখে মনে হচ্ছে অনেক সহজ ব্যাপার কিন্তু "আমাদের মেধাবী বিবাহ বিচ্ছেদ" এখানে এসে একেবারে চমকে দিচ্ছে। এই ঘটনাগুলো কবিতায় রয়েছে, আমার ভীষনই ভালো লেগেছে। অসংখ্য জায়গা রয়েছে যেগুলো ভাবার জন্য স্পেস দিয়ে রেখেছে। আমার ভীষন ভালো লেগেছে, আর যেটা বললাম যে সহজ ভাবে নেওয়ার বা আমার প্রত্যাশা এর পরে কি হতে পারে পুরো ব্লাইনড করে রেখে দিয়েছে, সমস্ত প্রত্যাশাকে ভেঙে দিয়ে নতুন নতুন দৃশ্য এবং ভাবনার মধ্য দিয়ে ও টেনেছে।" এত সুস্বাদু পুরোনো চোখ" অভাবনীয় ছিল। যেটা আমার ভালো লেগেছে। আমরা আসতেই পারিনা এই জায়গাটায়।

 

উমাপদ কর

দেবা বল শঙ্খর কবিতা শুনে কী মনে হল।

 

দেবাঞ্জন দাস

শঙ্খর  কবিতায় যেটা ভালো লেগেছে সেটা হল ও কবিতায় যে কাজটা করে সেটা হল কন্সেপটচুয়াল কাজ করেছে। ও ঘর নিয়ে একটা কবিতা লিখেছে। তারপরের কবিতাটায়  একটা পরিবারের এসেন্স আছে তার একটা কবিতা পরে চাষীর কথা আছে। আমার কাছে যেটা ভালো লাগলো সেটা হল এটা হয়ত চার নং কবিতা ও যা করেছে সেই নিয়ে, ওই যে  চাষীর যে কবিতাটা,  তার আগে পর্যন্ত হয়তো… ও কেন কনসেপ্টচুয়াল কবিতা লেখে আমার যেটা মনে হয়েছে, ও খুব স্ট্রেস দেয়, ফিরে এসে আবার ধরিয়ে দেয়, ফিরে এসে আবার ধরিয়ে দেয় ......  এই কাজটা ভীষনই ইন্টারেস্টিং  মানে যে কবি তার সমস্তটা দিয়ে কবিতাটা লিখছে পাঠক হিসেবে আমার খুব পছন্দের ......এবার যখন ও সেই চাষী  কবিতাটা লিখছে তখন ও এই কাজটা করছেনা তখন ও  স্ট্রেসটা অন্যরকমভাবে দিচ্ছে, তখন ও স্ট্রেসটা দিচ্ছে হচ্ছে কম্বিনেশন এর উপরে  তখন ও রিপিট করিয়ে স্ট্রেসটা দিচ্ছে।এটা আমার দেখতে ভাল লেগেছে মানে এই জার্নি টা, কবির এই জার্নি টা  খুব ভালো লেগেছে।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

রিপিটেশনটা একটা মজা তৈরি করেছে। 

 

উমাপদ কর 

দেবদাস আচার্য বা জয় গোস্বামীর রিপিটেশন এর মতো নয়

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

কিছু কিছু রিপিটেশন যে এত মাধুর্য তৈরি করে...

 

দেবাঞ্জন দাস

আমি তো বললাম এটা কেন ভাল লাগে তার কারন সে সবটা দিয়ে কবিতা লিখছে এটা ফিল করা যায়,এটা ওইরকম রিপিটেশন না, সে কতটা ইনভলভড হয়ে কবিতাটা লিখছে সেটা ফিল করা যায়।

 

স্বপন রায়

শঙ্খ তোর কবিতার একটা মোজাইক, কোলাজ টাইপ সেখান থেকে ভাবনা এই সমস্ত কিছু ছেঁকে তোলা এবং সেগুলো খুব মায়াবী একটা কলমের আঁচড়। তবে স্মার্টনেস না থাকলে সেটা ভালো লাগে না আর তোর সেই স্মার্টনেস টা আছে। কবিতার মধ্যে এই জিনিস তো সব কবিই লেখে এবং তুই যে ফর্ম এ লিখেছিস এরকম অনেকেই লেখে।তোকে তো আলাদা হতে হবে, যে কবি খুব সপ্রতিভ সে তার নিজস্ব কিছু সিগনেচার গড়ে তোলে। আমি আগে তোর  কবিতা পড়েছি সেইখানে ওই চেষ্টা টা আছে একটা কাটা শব্দ, জাস্ট একটা শব্দ বা দুটো শব্দে একটা বাক্য হয়ে যাচ্ছে আর বাকিটা এমনিতেই বুঝতে হচ্ছে,  এটা করেছিস।  আর যেটা ভাল লেগেছে কবিতার একটা সূত্র দিয়েছিস তারপর  আস্তে আস্তে সূত্রটাকে মুছে দিয়েছিস। সেটা…  মানে যখন মোজাইক শিল্প বলা হয় না  তাতে এটা করা হয়। এটা সাক্সেসফুলি করেছিস। বাক্যগুলোতেও অসম্ভব দক্ষতা লেগেছে। যেকোনো উদাহরণ দিয়ে বলা যায়। উদাহরণ গুলো আর রিপিট করছিনা। তো এতদিনের একটা বিরতি নিয়ে এভাবে লেখা মুস্কিল। তুই যেরকম ভাবে লিখেছিস৷ ভিতরে ভিতরে তৈরি হচ্ছিস। তোর আগের বই থেকে ডিপারচার হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

মানে ও নিজে জানে যে ডিপারচারটা হয়েছে। ও খুব সংযত ক্রিয়াপদের ব্যবহার করেছে, খুব সামান্য করেছে আর যেখানে করেছে খুব ভেবে চিন্তেই করেছে। 



Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger