Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।

রোয়াক অবসরে তৃতীয় গ্রুপ ডিসকাশনের সূত্র ছিল এই ছবিটি।

চেতন অচেতন শূন্য সাদা কালো কনক্লুশ্যন থেকে বিরত রাখে

উমাপদ কর, জয়দীপ মৈত্র, তন্ময় কুমার মণ্ডল এবং তন্ময় হালদার 

 

জয়দীপ মৈত্র- টপিক হচ্ছে ধরা যাক কবিতার পরমাণু। তাহলে ধরছি। আচ্ছা আমি খুব ছোট্ট একটা বিষয় বলছি। আবার একইসাথে খুব বড় বিষয়। এই ছোট্ট আর বড় একইসাথে কেন বললাম পরে আসছি। আমার কাছে, মানে আমার যেটা হয় আর কী, আমি ধরছি, এইটা, এই যে ধরা যাক কবিতার পরমাণু। আমি ধরছি এটা একটা কবিতার লাইন। তবেই আমি ওভারল্যাপ করতে পারব, বিষয় থেকে বেরোতে পারব ও আমার যেটা মনে হয় সেটা বলতে পারবো। তো, আমি যদি একটা ডায়াগ্রাম দেখি, আমি লিখছিলাম তখন, সেটা হচ্ছে যে, ওই ছবিটা, তার মধ্যে কিছু ইলেকট্রন ঘুরছে। প্রোটন আছে। ও চার্জহীন নিউক্লিয়াস। আমার কাছে, কবিতা, একটা প্যারাডক্স। যেখানে আমি একটা লজিক নির্মাণ করতে পারি, বা বিনির্মাণ করতে পারি, এবং তারপরেই সেই টপিকটাকেই আমি পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারি। এই যে নেগেটিভ ইলেকট্রন, যেহেতু সবই ধরে নেওয়ার প্রেক্ষিতে, এটাকে আমি ধরে নিচ্ছি, আমারই লিখনপদ্ধতি, যা দিয়ে উৎসকবিতা বা নিউক্লিয়াসের চার্জ আমি মুছে দিচ্ছি। আসলে লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়, এই যে অনন্ত কণাসমুদ্র, এর কতটুকুই বা ধরতে পারি? কণার যা নেচার, খুব অদ্ভুতভাবে, আমাদের লেখনপদ্ধতির মধ্যেও একটা ইনার ফিজিক্স কাজ করে। এই যে নেগেটিভ পজিটিভের খেলাটা, লজিকাল শিফটের খেলাটা, একটা লজিক নিয়ে এসে তাকে আবার ব্রেক করে দেওয়াটা, বা আপাতভাবে, যে মানে নেই, এই কথাটা, কবিতার মানে হয়না, এটা আমার কাছে খুব সচেতনভাবেই যেন এই ইলেকট্রনের একটা খেলা। মানে, উৎস কবিতার নিউক্লিয়াসকে মাঝে রেখে আমি আমার ভাবনাগুলোকেই নেগেট করছি, এটা আমার কাছে পরমাণুর মতই। সবকিছুর সাথেই সবকিছু মিশে আছে। আজকাল কখনো মনে হয়, একটা ফাঁকা থালা মাটিতে ফেললে তার ঘোরার যে প্যাটার্ন, তার সাথে পৃথিবীর ঘোরার প্যাটার্ন আমার কাছে যেন মিলে যায়, এবং অদ্ভুতভাবে সেই সাউন্ডওয়েভটা একটা স্পেশাল ফরম্যাট মেনে হয়। ফাঁকা ফাঁপা থালা ঘুরতেই থাকছে। এবং সাউন্ড আসছে। সেখান থেকে যদি সচেতনভাবেই ধরে নিই কবিতার পরমাণু , এই যে স্ববিরোধটা, আমার মনে হয় পোয়েট্রি ইজ ইটসেলফ আ প্যারাডক্স। ঘর্ষণ হতে হতে যাবে। এর কোনো শেষ নেই। আমিই নিজে একটা লেখার পরের লেখায় একদম উল্টো কথা বলতেই পারি। এবং এটাই আমার চেতনাটাকে শান্ত করছে ক্রমাগত। যেন চেতনাই শান্ত চার্জহীন নিউক্লিয়াস। এবং এই যে আমার ভাবনাটাকে কেন্দ্রর বাইরে ঘুরে ঘুরে নেগেট করছি, এবং একইসাথে একটা কবিতায় নিজের পজিটিভ এনার্জিটা প্লেস করছি, যা আমার চেতনাকেন্দ্রকে শান্ত চার্জহীন রাখছে, এইটা আমার কাছে একটা পারমাণবিক স্ট্রাকচার, এবং সেই সঙ্গেই একটা পোয়েটিক স্ট্রাকচার। 

 

তন্ময় হালদার- নিউক্লিয়াসের মধ্যে একটা নিস্তড়িৎ আছে, আর একটা পজিটিভ। এবার কবিতা যখন আসে, কখনো মনে হয় মনখারাপ থেকে আসে, আবার কখনো মনে হয় কোনোকিছুই নেই। আর কখনো মোটিভেশন থেকেও আসে। কীভাবে আসে জানিনা। তো ওই নিউক্লিয়াসের মধ্যে যদি ভেবে নেওয়া হয় যে ওখানে পজিটিভ আর নিস্তড়িৎ আছে, তাহলে নিস্তড়িৎ মানে এখানে ভাবতে পারি, যদি কিছুই মনে না হয়, যদি কবিতার মানে না থাকে, বা মানে আছে, নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে, আর পজিটিভ ভাবলে মোটিভেশন এটাও ধরতে পারি। আর নিস্তড়িৎ কে কেন্দ্র করে নেগেটিভ কণাগুলো চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার যে যেমনভাবে নেবে সেরকম হতে পারে। একে তো হচ্ছে কবিতা অনন্ত। তার অন্ত নাই। এবার খুঁজব কী? যা আছে সবই তো এখানে আছে। এভাবে ভাবা যেতে পারে। 

 

তন্ময় মন্ডল- এখানে যে ডায়াগ্রামটা ছিল, ধরা যাক কবিতার পরমাণু, আমি এখানে পরমাণু বলতে কবিতার আত্মাকে খোঁজার চেষ্টা হয়তো করছি। বা বলতে পারি বেসিক এলিমেন্ট খোঁজার চেষ্টা করছি। যেটা একদম প্রাথমিক একটা এলিমেন্ট যদি এলিমেন্ট হিসেবে ধরি তবেই। কয়েকটা প্রশ্ন আমার মধ্যে এই টপিকটা থেকে এসেছে। আচ্ছা আমরা কি সবাই একটাই কবিতা লিখছি? বিভিন্নভাবে, বিভ্রান্ত হয়ে একটাই? যদি তাইই হয় যে কবিতা হয়ে আছে, আমরা তার ট্রান্সলেট করছি, করছি কী দিয়ে? নাকি আমাদের যে সীমাবদ্ধতা আছে, তা দিয়ে অনন্তকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছি? আমাদের এই পাঁচটা রিসিভিং অরগ্যান তারও সীমাবদ্ধতা আছে। চোখ ওই সাতটা আলোর বাইরে আর দেখতে পারেনা। কান ওই কুড়ি থেকে কুড়ি হাজার, তার বাইরে শব্দ শুনতে পায়না, আমরা সীমাবদ্ধ, তার ভেতরে আরও সীমাবদ্ধ হয়ে সেই সীমাবদ্ধতা দিয়ে অনন্তকে আরও সীমাবদ্ধ করতে চাইছি। তাহলে কি আমরা একটাই কবিতাকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্তি দিয়ে লিখছি? আমরা যা লিখছি, তা কি তাহলে বিভ্রম? আর মনে হয়েছে, বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য কি লিখছি? আমরা কি একটা জায়গায় যেতে চাইছি, যেটা বিজ্ঞান বলছে থিয়োরি অফ এভরিথিং, যেটা ধর্ম বলছে সেই “এক” এ যাওয়া? সেই কারণেই কি কবিতার পরমাণু কথাটার উল্লেখ হয়েছে? ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন কালকে যে সিরিজটা পড়ছিলাম, ওটা লেখার আগে, এক জায়গায় গিয়ে আমার ফিলিংস হয়েছিল, আমরা অনন্তকে সীমাবদ্ধ করছি। এবং, আমরা এই পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে সীমাবদ্ধ করে পেশ করতে চাইছি। আমরা সেই অনন্তকে ধরতে পারছি না। আদৌ কি আমরা সেই অনন্তকে ধরতে পারব? পারব না। কারণ আমাদের সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাকে ধরতে পারব না। আবার আমাদের এই সীমাবদ্ধতা এই পাঁচটা ইন্দ্রিয়কে একযোগে লাগিয়েই তো আমরা তার কাছে যেতে পারবো। আর তো কোনও রাস্তা নেই। এই রাস্তা ছাড়া তো কিছুই নেই। ফলে এই রাস্তা ব্যবহার করেই আমাকে অন্যভাবে, কবিতা হয়ে আছে যে, তার কাছে যেতে হবে। এটাই আমার মনে হয়েছে। 

 

উমাপদ কর- ছবিতে পরিস্কার এটি একটা মডেল পরমাণু। মৌলিক পদার্থের অবিভাজ্য কণা। রাদারফোর্ড মডেল। হতে পারে তার পরেও অনুমিত কোনও মডেল কল্পনা। এখন এর সঙ্গে কবিতার যোগ সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। সূত্রটা- ধরা যাক কবিতার পরমাণু। সাধু চিন্তা নিঃসন্দেহে। মনে হচ্ছে আমাদের দৃশ্যমান বস্তুসমূহের গভীর-গহীনে যে মূল বীজটি রক্ষিত, তারই প্রেক্ষিতে একটা কবিতার দৃশ্যমানতার সঙ্গে তার বীজাধারটিকে আদৌ তুলনা করা চলে কিনা? চললে, কী কী দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানে তা প্রায় একরকম তার বিচার-বিশ্লেষণ? আর না চললে, কেন নয়, তার কারণ বিশ্লেষণ। যেহেতু ডায়াগ্রামে বিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতার একটা মেলবন্ধনের ব্যাপার উঠে আসছে, তাই বিজ্ঞানের কিছু কথা বলতেই হবে। আসি পদার্থের কথায়। আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় ৯২টি মৌল-পদার্থে সৃষ্ট এই বিশাল বিশ্বজগত। মৌল থেকে যৌগিক বা মিশ্র ইত্যাদি পদার্থ, আর তাতেই বস্তুনিচয়। আরও দুটো ভাগ হয় জৈবিক ও অজৈবিক পদার্থ। কিন্তু সবকিছুর মূলে সেই মৌলিক পদার্থ। এটি পদার্থের একটা বিশেষ ধর্ম। এই ধর্মই ধারণ করে আছে বিশ্বমণ্ডল। এই মৌলের ক্ষুদ্রতম রূপ একটি পরমাণু, যা নিজেও একটা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই নিজস্ব অবস্থানটা বজায় রাখে। কী সেই ধর্ম? না— পরমাণুর একটা কেন্দ্রক, যাতে প্রোটন ও নিউট্রন কণা থাকে জোটবদ্ধভাবে। আর এই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্রে রেখে, প্রোটনের সমসংখ্যক ইলেকট্রন কণা বিভিন্ন অরবিটে ইলেকট্রন কণার সংখ্যার একটা নির্দিষ্টতা মেনটেন করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। প্রোটন ও ইলেকট্রন কণার চার্জ সমান, নিউট্রন চার্জবিহীন। ফলে পরমানুটি আপাতভাবে চার্জবিহীন। কিন্তু কোনোভাবে যদি ইলেকট্রন কণা পরমানু থেকে ছিটকে যায়, তবে পরমানুটি্ ধনাত্মক চার্জড হয়ে পড়ে, যেহেতু ইলেকট্রন কণা ঋণাত্মক চার্জ বহন করে। এসব আমাদের সবারই জানা। এখন এর সঙ্গে কবিতাকরণের সাযুয্যটি কোথায়? আদৌ আছে কি? থাকলে তা কেমন করে তুলনীয়? এর পরেও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ও ভাবার কয়েকটা বিষয় আমি নিজে তুলে ধরতে চাই। এ নিয়ে অনেক আগেই আমি একটা গদ্য লিখেছিলাম, যা আছে আমার ‘রিলেদৌড়ের অনিঃশেষ’ বইয়ে। এখানে সেখান থেকেই সংক্ষেপে বলব। ক) অতি নিম্নচাপে পদার্থের ইলেকট্রন কণার দ্রুত নিষ্ক্রমণের কারনবশতঃ সৃষ্ট অদৃশ্য রশ্মির মতো হলো কবিতা। কবিতা, ক্যাথোডরশ্মি মনন থেকে উৎসারিত অদৃশ্য রশ্মিপাত। চোখে দেখা যায় না। আকারহীন সূক্ষ্মকণার বহমান স্রোত। প্রতিপ্রভ পর্দায় প্রতিপ্রভা দেখা যায়। অর্থাৎ কিনা, কবিতার উৎস থেকে অদৃশ্যতার ইতিহাস লেখা অবস্থায় শেষ হয় তার প্রতিপ্রভায়। তাকে দেখা যায় না। প্রতিপ্রভা দেখা যায় মাত্র। খ) কবিতা এক্স-রশ্মি। বিশেষ এক অবস্থা ও অবস্থানের সৃষ্টি করলে (অতিরিক্ত নিম্নচাপ এবং অতিদ্রুত ইলেকট্রন কণার নিষ্ক্রমণ এবং নিষ্ক্রমণ পথে ভারী অ্যানোড-পাতের ব্যবস্থা রাখলে) অদৃশ্য এই রশ্মি ভেদন-ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে পড়ে এবং ফোটোগ্রাফিক প্লেটকে নষ্ট করে দেয়। তাতে ভেদ করতে পারে না এমন পদার্থের প্রতিচ্ছবি রেখে যায়। কবিতারও রয়েছে ভেদন-ক্ষমতা। বিশেষ অবস্থা ও অবস্থানে মননের স্পার্ক থেকে উৎসারিত প্রবল রশ্মিকণার স্রোত ভেদ করতে করতে অভেদের দিকে যায়। ছাপ আর ছোপ রাখে মননে মননে। গ) কবিতা তেজস্ক্রিয় রশ্মি আলফা-বিটা-গামা। ভারী পদার্থ থেকে স্বতোৎসারিত রশ্মিই তেজস্ক্রিয় রশ্মি। স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকৃতিতে সেই সমস্ত বিশেষ পদার্থ থেকে ক্রমাগত রশ্মি নির্গমনে পদার্থের প্রকৃতির পরিবর্তন হয়। উদ্ভুত হয় অসামান্য শক্তির। কবিতার তেজস্ক্রিয় ক্ষমতা রয়েছে। মননসঞ্জাত এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি থেকে অসামান্য শক্তিরও উদ্ভব হয়। সেই শক্তিতে প্রভাবিত বা আবেশিত হয় অন্য সব মনন। এবং ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে তেজস্ক্রিয়তার লীলাখেলা। এতসব বলার অর্থ একটাই— কবিতা অদৃশ্য, কোনো বিশেষ অবস্থা ও অবস্থানে মানসলোকে কোনো ঘটন-বিঘটনে উৎসারিত হয় সূক্ষ্মকবিতালোক। আকারহীন সূক্ষ্ম এই রশ্মিপাতে যে প্রতিপ্রভার সৃষ্টি আপাতভাবে তাই আমাদের কাছে কবিতা। কবিতার ভেদন-ক্ষমতা আছে। স্বাভাবিক আলোকরশ্মির মতো হয়েও কবিতার যে স্পার্ক তাতে অনেক কিছু ভেদ করার পর হয়তো কিছুমাত্র প্রতিচ্ছবি সব রকমের ডাইমেনশন থেকে রেখে যায়। যদিও এই প্রতিচ্ছবি জীবন্ত ও প্রাণপূর্ণ। কবিতার উৎসমুখ থেকে ক্রমাগত নিঃসরণে আর স্বতস্ফূর্ত বিকিরণে শক্তির সৃষ্টি ও বিকিরণ ঘটে। শক্তি সৃষ্টির ক্ষমতা কবিতার রয়েছে, যা বিচ্ছুরিত হতে হতে ক্রম-অগ্রগামী। এখানে যেহেতু ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন কণা নিয়ে সহজেই অনেক কাজকারবার করার সুযোগ রয়েছে, তাই তা অনেকাংশেই কবিতার চাল-চলন ভাব-ভাবনার সঙ্গে সাযুয্যপূর্ণ। এতক্ষণ যেসব বলা হলো, তা পরমাণুর আউটার-মোস্ট সেল নিয়ে তথা ইলেকট্রন নিয়ে। এবারে নিউক্লিয়াসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। নিউক্লিয়াস দৃঢ় সংবদ্ধ। পজিটিভ তড়িৎযুক্ত। পরমাণু, কেন্দ্রক নিয়ন্ত্রিত। কেন্দ্রকেরই যা ভর ও ভার। এখানে কবিতার সঙ্গে এর সাদৃশ্য নেই বললেই চলে আমার মতে। কবিতার একটিমাত্র কেন্দ্রক হতেও পারে, আবার না-ও পারে। হতে পারে বহুকেন্দ্রিক। কারণ কবিতার উৎসমূলকে যদি একটি বীজ বা কেন্দ্রকের সঙ্গে তুলনা করি, তবে বিস্তারকালে তা আর একক থাকে না। এবং আমার যে কবিতায় বিশ্বাস, সে কবিতায় কেন্দ্রচ্যূতি বা বহুকেন্দ্রিকতার ভাবনা রয়েছে। ভাবনাবীজটি চিন্তা-চেতনার প্রসারণের ফলে আর একবিন্দুক থাকে না। হয় কেন্দ্রচ্যূত হয়ে পড়ে না হয় বহুকেন্দ্রিক হয়। হয় না একরেখগামী। একইসঙ্গে আরেকটা দিকও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো পরমানু কেন্দ্রক-এর বিগঠন। কেন্দ্রক সহজে ভাঙা যায় না। কিন্তু কোনো পদ্ধতিতে যদি ভাঙা হয়, তাহলে তা থেকে যে শক্তি সৃষ্টি হয়, তা পূর্বকথিত শক্তির তুলনায় লক্ষ-লক্ষ গুন বেশি। সেখানে ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় নিউক্লিয়ার ফিউশন বলা যায়। এই ঘটনায় অনেককিছু হতে পারে। একদিকে সৃষ্টি হতে পারে মানবকল্যানের দিকটি বিবেচনা করে। আবার ধ্বংসলীলাও সম্পন্ন হতে পারে মানবকল্যানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এখানে দুয়ের মধ্যে ঘোরতর পার্থক্য। কবিতা, যা শিল্প, তা মানুষের কল্যান মানুষের বিনোদন মানুষের সৃষ্টির কথাই বলে, ধ্বংসের কথা বলে না, অপশন হিসেবেও আসে না। আমরা কবিতার কেন্দ্র ভেঙে দেওয়ার কথা বারবার বলি। কিন্তু পরমাণুর ক্ষেত্রে সে-কথা সহজে বলতে পারব না। সুতরাং সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য মিলিয়েই এই কবিতার পরমাণু কনসেপ্ট বলে আমার মনে হয়। 

 

শঙ্খদীপ কর- ওকে আমি বলছি এবার। এক জায়গায় উমাদা এই যে অদ্বৈতবাদের কথা বললে। আমরা একটাই কবিতা লিখছি কিনা, জয়দীপ, তুই এটাকে ওয়ান ইলেকট্রন থিয়োরির রেসপেক্টে কিছুটা বল।  

 

জয়দীপ মৈত্র- এই যে আমরা একটাই কবিতা লিখছি কিনা তন্ময় দা প্রশ্ন করলো, একটাই ইলেকট্রন, সে ঘোরাফেরা করছে বলেই ব্রহ্মান্ড বা পৃথিবীটাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখছি। যে ধরো, একটা নদীরই অংশ তার বাঁক। আমরা মাঝের দ্বীপে দাঁড়িয়ে দেখছি বলে অনেক নদী মনে হবে। কিন্তু টপ থেকে দেখলে বিভিন্ন বাঁক নেওয়া একটিই নদী। এরকম একটা থিয়োরি এখন অনেকেই আলোচনা করছে। আর দ্বিতীয় কথা, অদ্বৈতবাদ প্রসঙ্গে, শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছেন, অন্ধের হাতি দেখা। সবাই তাইই করছি। সেটা নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। আর তৃতীয়, সীমাবদ্ধতা। এই যে ধরতে চাই, পারিনা। আমার মনে হয়, এই সীমাবদ্ধতাও অনন্তেরই অংশ। এটা আলাদা কোনও অংশ নয়। 

 

তন্ময় মন্ডল- কিছুই বাদ দেওয়া যায়। 

 

জয়দীপ মৈত্র- তুমি হয়তো ভাবছ আমরা সীমাবদ্ধ। অনন্ত নিজেই এই প্রকাশটুকুর জন্যেই বসে আছেন হয়তো (হাসি) ...... এই যে চেতনার জায়গাটা, আমি এইট ডি ল্যাটিস থেকে উপনিষদ, মানুষের দর্শনগত রিফ্লেক্সগুলো যে যে ভাবে লিখিত হয়েছে, সবকে যদি মিলিয়ে ধরি, যদিও অক্ষম অনুবাদ, তবু, এইটা একটা, কি বলব, চেতনা নিজেও হয়তো আত্মবিস্মৃত, আমরা হয়তো তাকে হেল্প করছি। এটা আমার মনে হয়। আমরা হয়তো যা খুঁজছি, যাকে প্রকাশ করছি, সে হয়তো ভুলে গেছে বলেই এই সৃষ্টিটা। উমা দা বিভিন্ন ফোর্সের কথা বলছিলো। তো, আমরা যখন একটা কবিতা লিখছি, সেই কবিতাটার, সজলের হয়তো মনে থাকবে, আমরা কীভাবে ডিসাইড করি তার শেষ লাইন কোনটা? একটাই যদি কবিতা লিখে থাকি, তাহলে তো কবিতার শেষ লাইন বলে কিছু হয়না। তাহলে কবিতাটাকে শেষ করি কেন? পরিসর ভেবে? কেন শেষ টানি? এরপর সেই মুহূর্তে আমাদের আর কিছু লেখার নেই বলে। এটা একটা জার্নি। এইবার, এই জার্নিটার পুরোটা আমরা দেখতে পাইনা। যদি এই গ্রুপ ডিসকাশনকেও প্রিজমে টেনে নিই, নেওয়া যায়, কারণ রিজিডিটি নেই কবিতার ইউনিভার্সে, পরমাণুর ক্ষেত্রে বলছি যেটাকে বলছি চার্জহীন শান্ত চেতনা বা উৎস কবিতা, সেটাকে নেগেট করছি ইলেকট্রন দিয়ে, সেটাকেই আবার প্রিজমের উৎস কবিতায় বিশ্লিষ্ট বলা যায় কি? মানে ওটাও তো পরমাণুর খেলা। 

 

শঙ্খদীপ কর- অবশ্যই। এই যে আমরা আলোচনা করছি, যে আমরা একটাই কবিতা লিখছি কীনা, শেষ করছি কিনা, আদৌ শেষ আছে কিনা, নাকি একটাই ট্রেন, ডিফারেন্ট আসন, এই মুহূর্তে শূন্য, আবার এই মুহূর্তেই পুর্ণ, এমনকি উপনিষদের প্রথম শ্লোকও তাইই বলছে। যদি একটাই কবিতা লিখি, তাহলে সেখান থেকে এই কবিতাগুলো সরিয়ে নিলেও সেটা পুর্ণ থাকছে। আবার এগুলোকে অ্যাড করলেও সেটা শূন্যই থাকছে। 

 

স্বপন রায়- একটা ফ্যালাসি আছে। একটাই কবিতা, অথচ যখন লিখে ফেলছি, তা আবার সেপারেট হয়ে যাচ্ছে। তার চলন বলন কথন কোর সব আলাদা। দেখতে পাচ্ছি। কবিতা যেহেতু হয়েই আছে, সেহেতু বিভিন্ন ধরনের কবিতার ফিলিংসও একটা সমগ্র। তার মধ্যে বহু পরমাণু বহু বিভাগ সবকিছু মিলিয়েই আমি বলছি। 

 

শঙ্খদীপ কর- তন্ময় যার কথা বলছে, যে একটিই লিখিত কবিতা, যেটাকে আমরা সিংগল ইউনিট অফ পোয়েট্রি বলছি, তার থেকেও লার্জার সেন্সে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু ও একটা মোমেন্ট, একটা সেপারেশনকে বলছে। 

 

তন্ময় মন্ডল- এই যে তুমি বলছিলে জন্মেছ, এই প্রকৃতির মধ্যে থেকেই জন্মেছো। তোমার হাত, তোমার পা, তোমার কোষ মিলে, তা রিপ্রেজেন্ট করছে। আমার মধ্যেও একই এলিমেন্ট। আমার সিস্টেমে কিন্তু অন্যভাবে রিয়্যাক্ট করছে। 

 

শঙ্খদীপ কর- ধরো তুমি ভেজ, আমি ননভেজ। তুমি ঘাস খাচ্ছ, আমি চিকেন খাচ্ছি, সিস্টেমে খাদ্যটাও কিন্তু শক্তি উৎপাদন করছে। কোষ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঘাস আর চিকেন আলাদা আলাদা ভাবে করছে। তার মানে, ওই জায়গায় ঘুরে যাই, যদি আমরা যেতে চাই, না যেতে চাইলে বা ডিফার করতে চাইলে থাক। কিন্তু গেলে বলব, ওই যে, দেবাঞ্জন দা বলল, তার প্রেক্ষিতে বলছি, এই আলাদা আলাদা ভাবে করাটাই ব্যাপার। 

 

উমাপদ কর- আমার সাথে কতগুলো জিনিস আমি দেখছি, তবুও শুধু হাইপোথিকেশন দিয়ে কাজ করব, তা হয়না। যে অব্দি আমার অধীত জ্ঞান, তারপর থেকেই আমার হাইপোথিকেশন শুরু। এবার আমি সিংগল ইলেকট্রন দিয়ে শুরু করি। প্রথমেই বলেছিলাম যে, পদার্থ বা বস্তু থেকে, মৌল দিয়ে করলে বোঝানো সহজ, ধরি সোনা, সোনার থেকে, একটা ইলেকট্রন সরিয়ে দিলে সে তো কোথাও না কোথাও যাবে? সে তো উবে যাবেনা। সে আরেকটা বডিতে যাবে। এই থিয়োরিটা সবসময় একটা ওরিয়েন্টেশন ক্রিয়েট করে। এবং পৃথিবীকে নিস্তড়িৎ রাখে। এই রাখার একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে একটা প্লাস, এবং আরেকটা মাইনাস করা। এটাই এই থিয়োরির দিক। নাহলে, এই থিয়োরি খুব কাজের নয়। এইবার কথাটা হচ্ছে, এই প্রোটন বা নিউট্রন, এদেরও তো ভুমিকা আছে? এই পাঁচটা ইন্দ্রিয়র কথা হলো। এই পাঁচটা ইন্দ্রিয়ও তো বলছে পর্যাপ্ত নয়। তাহলে বলা হচ্ছে এই মডেলএর প্রেক্ষিতে নিউট্রন কী? তার ভূমিকা কী? তা তো নিস্তড়িৎ। আবার প্রোটন ইলেকট্রন আছে। কিন্তু নিউট্রনের শুধু ভরবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনও ভূমিকা নাই তা তো হয়না। সেটা নিউক্লিয়ার ফিউশনে ধরা পড়ে। জয়দীপ বলছে, প্যারাডক্স। as if a child is playing from another universe, who is far better than us in case of thinking… এগুলো কল্প হোক, বিজ্ঞান হোক, ভাবনায় হোক । থাকুক। প্যারাডক্সের সাথে কিন্তু বিভ্রম শব্দটাও আসে। বিভ্রমের সাথে ভ্রম শব্দটা জড়িত। বিভ্রম একা আসেনা। বিভ্রমের সাথে যুক্ত মায়াবাদ। রজ্জুতে সর্পভ্রম হলে মায়া আসে। এই মায়া আমাকে বিভ্রমে আনে। 

 

শঙ্খদীপ কর- এই এইট ডি ল্যাটিস থিয়োরিটাও ধর্মকেই বা মায়াকেই প্রতিষ্ঠা করছে। এখানে আমাদের ডিসকাশন অব্দি আমি কথাটা ইচ্ছাকৃত ভাবে তুলিনি। But it is actually explaining maya… 

 

উমাপদ কর- এই মায়াতে , বিবেকানন্দ বলছেন, মায়ার সাথে বিভ্রম যায়। প্যারাডক্সও কিন্তু একটু হলেও এক জায়গায়। যদি উপনিষদ ধরি, সে বলছে, ছিল এক, হলো বহু, তাহলে একের দিকে যাব কীভাবে? আমরা ভেদ থেকে অভেদের দিকে যাই। এই বিন্দুটা কিন্তু এক নয়। এইটা ভাবার খুব দরকার আছে। যদি বিগ ব্যাংকে অনেক সম্ভাবনার একটা ভাবা যায়, তাহলে তা কণিকামাত্র। ফলে, সেই ধরা যাক কবিতার পরমাণু, তা শেষ অব্দি একটা সম্ভাবনাতেই শেষ হচ্ছে, একটা সম্ভাবনা, কিন্তু তা অন্য সম্ভাবনা। এই এক ও অন্যর তফাতই হয়তো এক ধোঁয়াশা। যা কবিতাকে চেতন অচেতন, শূন্য এক, সাদা কালো জাতীয় যেকোনো কনক্লুশ্যন থেকে বিরত রাখে। 

 

এই ডিসকাশন এখানেই শেষ হলো। 



Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger