Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।


রোয়াকে
কবিতা পড়লেন পার্থসারথি ভৌমিক
আলোচনা করলেন স্বপন রায়, চিত্তরঞ্জন হীরা, উমাপদ কর, সজল দাস, জয়দীপ মৈত্র

সুত্র ধরলেন উমাপদ কর

এবার কবিতা পড়বে পার্থসারথি ভৌমিক।  আজ ভোর চারটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, আজকের এই ক্যাম্পে আসবে বলে। কামালগাজি তে থাকে। নয়-এর দশকে কবিতা লিখতে এসেছিল, আবৃত্তিকার ছিল,  কবিতা লিখতে লিখতে কবিতা লেখা বন্ধ করে,  আবার শূন্যদশকে এসে নতুন করে লিখতে শুরু করে। বয়সে আমাদের থেকে বছর দশেকের ছোট, সেই হিসেবে ওর নয় দশকের কবি হওয়া উচিত ছিল কিন্তু নিয়মিত না হওয়ার কারণে, ও শূন্যকেই মুলত রিপ্রেজেন্ট করে। ওর মধ্যে প্রথমদিকে আবহমান কবিতাধারার একটা ঝোঁক ছিল। এখানে অনেকেই ওর সেই পর্বের লেখালিখি পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই এব্যপারে আমার সাথে সহমত হবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ও যখন লিখতে আসে তখন ও নিজেকে রিফর্ম করে। একটা নতুন ধরণের রেজার‍্যেকশন হয় ওর মধ্যে এবং ও আর আবহমান বাংলা কবিতার

প্রতি অনুরক্ত থাকতে পারেনি। ওর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তার প্রমান। এছাড়াও অনেক জায়গায় ওর কবিতা শুনেছি, আড্ডা হয়েছে, তাতে আমার একথাই মনে হয়েছে।

ওর সাথে আমার ব্যাক্তিগত যোগাযোগ যথেষ্ট, সেই দিক থেকে বলতে হলে বলবো, পার্থসারথি ভৌমিক কবিতায় আসে, কবিতা থেকে বেরিয়েও যায়। আবার কবিতায় আসে, আবারও কবিতা থেকে বেরিয়ে যায়। যেমন গত দেড়-দু বছর ও কবিতার বাইরে আছে। কিন্তু ওর মধ্যে কবিতার প্রতি একটা অসম্ভব ভালোবাসা আছে, আর একটা কথা না বললেই নয় যে মানুষ হিসাবে ও আনপ্যারালাল। এবার কবিতা পড়ছে পার্থ।

 

পার্থসারথি ভৌমিকের কবিতা [প্রথমভাগ]

[আমি প্রথমে আমার প্রথম বই অ্যামিবার ক্ষনপদ থেকে কয়েকটি কবিতা পড়বো, পরে দ্বিতীয় বই সেলসিয়াস থেকে পড়বো।]

 

নতুন-দৌড়

আলোর ফুলদানির ভেতর ঝম্পক ছুটছে এক হরিণ-সরণি  ভোজবাজি হয়ে বাইরে ঝুলে পড়েছে আতরের বাগান  ম ম মদালসা ঘাসচোখ নরম মাটিতে নোঙর সর্বনাশা  সাগর বুলিয়ে চলেছে ফেনিল  রঙ-তুলি  বালিদের গায়ে  বিপর্যয়ের বর্ণমাখা অক্ষরের রক্তরাগ ডিঙিয়ে সাদা বিশ্রামের জন্ম  বৃষ্টি-ধোয়া রামধনুর বঙ্কিম মুদ্রা থেকে আলস্যের  ছিটকে ফেরা দেবদারুতে নতুন-দৌড় ।       

 

পাল   

বালি শুষে নিয়েছে সরে যাওয়া লবনের জলদাগ ।

 

উপুড় নৌকোর শূন্যখোলে হেলানো মাস্তুল     

টুকরো হ’য়ে উড়ে গেলো অরণ্যের দিকে ।

পাখি বসে ছিল ভ্রূ–র নির্দেশে ।

পালক থেকে অরণি অম্নি দাবানল ।

পুড়ছে তো বাদ –বিসম্বাদ, মোম রাখা আছে কোটরে ।

 

অন্ধ আলোর দিকে সুবাস ভাসিয়ে দিলো হাস্নুহানা ।  

 

মোহনা

এক সমতল ভ্রমের ওপর দিয়ে মুহূর্ত পার করছে ঘুম । একটি সুন্দরী জিরাফ তার অনন্ত গলা বাড়িয়ে দিয়েছে চোখের পাতার দিকে । পাতার নীচে ক্ষুধার্ত মোহর  থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো, গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল । তরঙ্গের অভিঘাত চিনে  জলজ শৈবাল মুখে সমুদ্র-গভীর থেকে উঠে আসছে মাছের পঙক্তি  মোহনার ঢেউ-এ ক্রমশ শৈবালে ঢেকে যাচ্ছে বোবা        জিরাফ ।


[এবার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়ছি।]

 

উমাপদ কর  [প্রথম বই থেকে কবিতা পড়বার পর উমাদা বললেন। ]

পার্থর ক্ষেত্রে আলচনাটাকে আমরা দুভাবে ভাগ করে করতে পারি। এই প্রথম বই থেকে পড়া কবিতার আলোচনা, আর পরের বই থেকে পড়া কবিতার আলোচনা। আপাতত যতটুকু পড়া হল তার ভিত্তিতে আমি সজলকে এই কবিতা গুলো নিয়ে কিছু বলতে বলছি।

 

সজল দাস

কবিতা বা কোনও লেখা ভালো লাগছে এটা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে খুব কঠিন। ভালো লাগছে এটা অনুভব করতে পারি। কিন্তু কেন ভালো লাগছে সেটা বলা মুশকিল। হয় আমি কখনও যাওয়ার চেষ্টা করিনা কেন ভালো লাগছে এখানে, নাহয় পারিনা। তাছাড়া আমি কবিতা পড়ে অনুভবে বিশ্বাসী। মানে চোখে পড়ে। আপাতভাবে শুনে আমার যেটুকু মনে হল বলছি। এই তিনটে কবিতায় শব্দকে যে ইঙ্গিতের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বা যে ইঙ্গিতের দিকে শব্দগুলো পৌঁছাচ্ছে তা আমার খুব ভালো লাগছে। কেন লাগছে বলতে পারবো না কিন্তু এই যে যাওয়াটা, বা উনি গিয়েছেন কিনা জানিনা আমি শুনে যে জায়গায় পৌঁছালাম সেই জায়গাটা আমার এক অন্য অনুভূতির সৃষ্টি করছে, যেটা ভালো লাগছে আরকি। এই যে অনন্তগলা, এখানে অনন্ত শব্দটা না বললেও যে জায়গায় পৌঁছাচ্ছে তা তো অনন্তই। চোখের পাতার দিকে এই যে পৌঁছাচ্ছে একটা জিরাফের গলা, এটা কিন্তু একটা অনন্ত জার্নি। যা ইটসেলফ আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ জিরাফের গলা কখনও অনন্তে পৌঁছাতে পারে না। এই যে অনুভুতিটা, এটাই ভালোলাগা।

 

উমাপদ কর

(সজলকে) আচ্ছা, শেষে গিয়া যখন বলছে বোবা জিরাফ, তখন কি বোবা শব্দটা বাড়তি মনে হচ্ছে? কারণ জিরাফ তো বোবাই।

 

সজল দাস

আসলে আমি ওটা নিয়ে ভাবিইনি। তাই ওটা নিয়ে বলছি না, আপাতত এই অনুভূতির জার্নিটা নিয়েই বললাম।

 

উমাপদ কর

প্রথমে সুন্দরী জিরাফ যখন বলেছে তখন আসাধারণ লেগেছে, কিন্তু শেষে যখন বোবা জিরাফ বলছে…

 

সজল দাস

ওই লেখাটা আর একবার পড়বে…

 

স্বপন রায়

আমি দেবাকে বলবো ভাবতে, আমাদের নন্দন তাত্ত্বিক যে প্রকরণগুলো আছে, সেই দিয়ে কি কবিতার বিচার করা…

 

উমাপদ কর

না না, বিচার তো করছি না আমরা…

 

দেবাঞ্জন দাস

না অবজেক্টিভলি তুমি কীভাবে বলবে…

 

স্বপন রায়

কবিতায় এই ধরণের আলোচনাতে আমরা আলাদা করে প্রকরণগুলো ভাবতে পারি কিনা সেটাও ভাবা দরকার।

 

উমাপদ কর

হ্যাঁ, সেটা ভাবা দরকার।

 

দেবাঞ্জন দাস

প্রকরণ না নিয়ে আসলে তো তুমি অবজেক্টিভলি আসতে পারবে না!

 

স্বপন রায়

আমরা প্রতিষ্ঠিত প্রকরণ নিয়ে ভাবছি, যেমন আমি যখন প্রথম সমীরণের কবিতা পড়তাম, আমার ভালো লাগত না, আমার মনে হত সুরর‍্যিয়াল। তারপরে আমি ওকে জানিয়েওছি, যে আমি না তোমার মত লিখতে পারবো না, কারণ আমার কোনও প্রকরণ নেই যা দিয়ে ওই ভালোলাগাগুলো চলে আসছে। আমি ওকে বলেছি ওর ছবি এবং কবিতার বইটা নিয়ে যখন আলোচনা করি তখন। মানে, ওই প্রকরণহীনতা আমার আছে। আমি ওই টেকনিক্যাল টার্মগুলো এবং ওগুলো সম্পর্কে সব জানি, সেই দিয়ে আমি একটা লেখা খাড়া করে দিতে পারবো, কিন্তু যখন আমি করতে যাচ্ছি, শুধু সমীরণ না, উমা বা রঞ্জন, বা আমাদের সমসাময়িক বা কিছু সিনিয়র, অনেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি একটা প্রকরণহীনতা আমার মধ্যে আছে, সেটা নির্দিষ্ট যে প্রকরণ নিয়ে আমরা বিচার করি, সেটা মিসলিড করছে। সেটা কবিতাকে খাঁচায় ভরে দিচ্ছে।

 

দেবাঞ্জন দাস

সেদিনকে বলছিলাম, তপেশদার লেখার ফার্স্ট রিয়্যাকশন সেটাই ছিল। কী হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!

 

স্বপন রায়

ঠিক তাই, কী হচ্ছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না! তপেশের লেখা তুই কী বলবি বল! হঠাৎ মনে হয়, আরে এত কাঁচা, তারপরে মনে হয় আরিব্বাস কি লিখছে! 

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

ভীষণ স্পেশ ওর লেখায়, খুব স্পেশ।    

 

সজল দাস

ওই লেখাটা আর একবার হোক

 

পার্থসারথি ভৌমিক

এক সমতল ভ্রমের ওপর দিয়ে মুহূর্ত পার করছে ঘুম । একটি সুন্দরী জিরাফ তার অনন্ত গলা বাড়িয়ে দিয়েছে চোখের পাতার দিকে । পাতার নীচে ক্ষুধার্ত মোহর  থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো, গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল । তরঙ্গের অভিঘাত চিনে  জলজ শৈবাল মুখে সমুদ্র-গভীর থেকে উঠে আসছে মাছের পঙক্তি মোহনার ঢেউ-এ ক্রমশ শৈবালে ঢেকে যাচ্ছে বোবা জিরাফ।

 

সজল দাস

অনন্ত শব্দটা খারাপ লাগছে না কিন্তু, ভালো লাগছে।

 

পার্থসারথি ভৌমিক

না থাকলেও হত...

 

সজল দাস

না। না থাকলে হত না।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

না থাকলে হত না এটা !

 

সমীরণ ঘোষ

উমাদা শুধু বলছে ‘বোবা’ টা।

 

স্বপন রায়

‘বোবা’ টা ব্যালান্স করছে, লাইনটাকে।

 

সমীরণ ঘোষ

ঠিক, ব্যালান্স করছে।

 

দেবাঞ্জন দাস

ওই লাইনের ‘অনন্ত’টাকে এই লাইনের ‘বোবা’ ব্যালান্স করছে।

 

স্বপন রায়

হ্যাঁ, দাড় করিয়ে রেখেছে।

 

সজল দাস

মাধুর্যটা ওখানেই আছে।

 

ঊমাপদ কর

কিন্তু আমি বলছি একজন কবি তারের ওপর দিয়ে হাঁটবে না কেন?

 

জয়দীপ মৈত্র

তারের ওপর দিয়ে বলতে?

 

উমাপদ কর

তার, তার…

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

সরু তারের ওপর দিয়ে…

 

সজল দাস

টানটান হবে না কেন বলছো?

 

উমাপদ কর

না না, আমি বলছি, তারের ওপর দিয়ে হাঁটবে না কেন?

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

ব্যালান্স…

 

স্বপন রায়

ওই একটা ম্যাজিক…

 

উমাপদ কর

এই যে বলা হচ্ছে ব্যালান্স করবার জন্য ‘বোবা’ শব্দটা এসেছে, কিন্তু ব্যালান্স করতেই হবে এর তো কোনও মানে নেই! আচ্ছা এই কথা দিয়ে এই আলোচনা শেষ হোক। পরের কবিতাগুলো শুনি।

 

পার্থসারথি ভৌমিকের কবিতা [দ্বিতীয়ভাগ]

[এবার আমি সেলসিয়াস কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়ছি।]

 

ধাপ্পা

 না   মন্থর হেঁটে যাচ্ছে তাও না  ;  চিৎ-কাছিম      

 নাসা থেকে এইমাত্র স্যাটেলাইট হুসসসসসস ............

 দুজনকেই  একইসাথে অতিক্রম করে যাচ্ছে

 ঢং ।

 

খিদে বাড়াতে অ্যাস্পারাগাস স্যুপ রেস্টুরেন্টে ,    

মেইন কোর্সে পিঁপড়ের ডিম  জম্পেশ    

দুটোকেই এক মেনুতে সাপটে খাচ্ছে  

সং ।

 

ক্যালভিন ক্লেইনের পোশাকে মডেল , 

শবরের গা ধনুকের বাঁক নিয়েছে

দুটোই এক ফ্রেমে জব্বর মানাচ্ছে  

রং ।

 

উইলিস টাওয়ার থেকে ভদকা নেমে আসছে

ঝুপড়ি ঘর উঠে যাচ্ছে বাংলায়  

দুজনেই একইরকম নেশায় 

টং ।

 

অং বং দুটো চোখের সাথে শুভাশুভ-দৃষ্টি  সারছে

ডুমুরফুল –চং ।    

 

 

রিমলেস

চতুষ্কোণ অভাব প’রে তুমি          রিমলেস 

গঙ্গা আটকে রেখেছ ।  বাহাদুরি , দু-চোখের

খুবপল্লবে স্থির । শিকড়ে হলুদ জ্বর নিম গায়   

মাটি জপে চপল ডরোথি  । ফ্রকের বিরুদ্ধে

যত শীত ,  কিশোরীর কোঁকড়ানো চুল লিখে

পার হয় লোহিত সাগর । তরুণ জাহাজ-মাখা 

নুনে আঁকা কার্টুনে হেসে ওঠে এক মুখ-বালি    

তিল লাগে বয়সের ফ্রেমে রাতবিন্দু নামলে চিবুকে ।

     

ট্র্যাপিজিয়াম

রঙে গুলে গেলে হাতি হই , পাঞ্জাবী হয় বটগাছ ।

রিখটার স্কেল যা মাপে , দর্জিকে অনন্ত দিয়ে গুণ

স্ট্রবেরীকে কোলাহলে ভাগ করে দিয়ে বিন্দাস

শুয়ে আছি ঘুঙুরপ্লাবনে । ক’ নুড়ি বিয়োগ করলে

কম পড়বে না সুতো । যাও , অ–নার্সে বুলবুলি যোগ

গান তোলা । ক্ষত করে ফেলে আসা ক্লাসে অঙ্ক 

পাতা ছিল , হাঁটু ভেঙে  বুনেছ শালের ঘন শ্বাস    

ঋজুতা টপাস করে ঝরে গেলে      জলের হ্যাঙার    

 

সেলসিয়াস ( ১ )

টগবগ করে ফুটন্ত ঘোড়া বাষ্প হয় , যে পুরুষ আগুনের আধার ,  তার বিস্তার করে মহাকাল                            

সেলসিয়াস ( ০ )

শূন্য জরায়ু মাথায় করে যে নারী জল ভরতে হাঁটে , শক্তি বিয়োগের পথে তার গর্ভে জমাট বাঁধে তুষারের শুভ্রতা       

                               

সেলসিয়াস ( -১ )

শীতল অরন্যের থাবার সামনে খেলতে খেলতে শূন্যের চরমে পৌঁছে  যে শিশুটির ঘুম আয়তন হারিয়ে ফেলেছে , হামা দেওয়া আলো , তার জন্ম হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা নিয়ে খুলে রাখে অমৃত-কলস ।       

 

উমাপদ কর

জয়দীপ বল।

 

জয়দীপ মৈত্র

এই কবিতার মধ্যে একটা দৃশ্যকে তৈরি করে সচেতন ভাবেই ভেঙে ফেলার একটা জায়গা আছে। দৃশ্যটাকে যেন তৈরিই করা হচ্ছে ভেঙে ফেল্বার জন্য। আর সেলসিয়াসের যে সিরিজটা, আপনি হয়তো খেয়াল করবেন, আমি আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এই কারণে যে আমি শুনে কবিতা বিশ্বাসই করিনা। আমার মনে হয় যে কবিতা আর আমার মধ্যে একটা মানুষ ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায়। সেইজন্য কণ্ঠস্বরের পরিবর্তে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম, যাতে ব্যারিয়ারটা না থাকে। আমি দৃশ্যগত ভাবে কবিতা পড়ি, শ্রুতিতে আমার বিশ্বাস নেই। ভালো লেগেছে। কিছু কিছু জায়গায়, আমার মনে হয়েছে যে, কিছু শব্দ এমন এসেছে যে অমোঘ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর কিছু শব্দ এসেছে, যেগুলো আমার বাড়তি বলে মনে হয়েছে। এবং কবিতা যখন চলছে, চলতে চলতে এক একটা অদ্ভুত বাঁক আছে, এই বাঁকটা কিছু কিছু কবিতার ক্ষেত্রে আমার খুব ভালো লেগেছে। যেমন সেলসিয়াস সিরিজের তিনটে কবিতা আমার খুব ভালো লেগেছে। এই বাঁকগুলো আমার মনে হয়েছে ঝলসে উঠেছে। আবার দু-একটা জায়গায় মনে হয়েছে না আনলেও হত। এই, এটুকুই।

 

উমাপদ কর

আমি তো প্রায় কিছুই বললাম না, এবার বলি। সেলসিয়াসের যে প্রথম কবিতাটা, তাতে প্রচুর অতিকথন আছে, এত কথা না বললেও হয়। এটা আমার একটা দোষ হতে পারে, এটা কদিন আগে আমি চিত্ত-র সঙ্গে শেয়ার করছিলাম, আমি গত চার বছরে যে কবিতা লিখেছি, আমি তো আমার পেরিফেরি দিয়ে আরেকজনকে বিচার করবো, আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার কবিতাভাবনা, আমার চিন্তাচেতনা দিয়ে তো তার কবিতায় পৌঁছাতে চাই, সেক্ষেত্রে গত চার পাঁচ বছরে আমি ম্যাক্সিমাম আট নয় লাইনের বেশি কবিতা লিখিনি। তার মধ্যেও বেশিরভাগ তিন-চার-পাঁচ লাইনের। এই লিখতে গিয়ে আমার একটা দোষ হয়েছে, যার-ই একটু বড় কবিতা, একটু বেশি কথা বলা কবিতা পড়ি আমার মনে হয় এটা অতিকথন দোষে দুষ্ট। এই কবিতার ক্ষেত্রেও এটা আমার মনে হয়েছে। সেলসিয়াস যেটা দিয়ে তুই শেষ করলি, হ্যাটস অফ টু ইউ। কবিতায় এই যে ভিন্ন ভাষার শব্দ, বাংলার মধ্যে আনা এই কাজটা আমি ২০০৫ সালে প্রকাশিত আমার ‘অপর বসন্ত’ বইয়ে করেছি। প্রচুর। ইংরেজি শব্দ। স্পন্টেনিয়াসলি এসেছে। সেই কাজ নিয়ে উৎপল কুমার বসু আমাকে বলেছিলেন, ‘এত ইংরেজি শব্দ কেন?’ সবকটা তো ইনভেরিয়েবল ছিল না। উনার কথার পর আমি, নিজের বইটা আবার পড়ি, ভাবি। এই সেলসিয়াস প্রসঙ্গে আমার ওই কথাটা আবার আজ নতুন করে মনে হল। এই যে জয়দীপ কিছুক্ষণ আগে অমোঘ শব্দটা ব্যবহার করেছে, এই অমোঘ শব্দটা দুটো পার্সপেক্টিভে আসতে পারে; একটা হচ্ছে পজিটিভলি আসতে পারে, হ্যাঁ, এটা অমোঘ - বসাতেই হবে। আরেকটা হচ্ছে শব্দমোহবন্ধ। শব্দের প্রতি প্রত্যেক কবির কিছু দুর্বলতা থাকেই এবং সেই দুর্বলতা কাটাতে বহু সময় লাগে। এখানে শুধু প্রথম কবিতাতেই নয় আমার মনে হয়েছে পরের কবিতাগুলোকেও আরও নিংড়ানো যেত। কবিতায় যে সুক্ষানুভূতির জায়গাগুলো তৈরি হচ্ছিল, যেন শ্রুতিতে এসে নষ্ট হচ্ছে। এই এত ভারি ভারি শব্দ পরপর বসিয়ে দেওয়ায় এবং এত এত মাত্রাযুক্ত শব্দ বসানোর জন্য, কবিতার যে অভিঘাত, চিন্তনের যে অভিঘাত, প্রকরণের অভিঘাত, তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এগুলো ভাবার বিষয়। আমি ভাবতে বলবো কবিকে। আমি সবটাই নেগেটিভ বললাম, সমস্ত পজিটিভগুলোকে ধরে। মানুষের কাছে তো এক্সপেকটেশন আমাদের বাড়তে থাকে! পার্থ-র অ্যামিবা আমি পড়ে, ওকে বাড়িতে ডেকে আলোচনা করেছি, কয়েক ঘণ্টা ধরে ইন্টার‍্যাকট করেছি। সেলসিয়াস আমার কাছে তার থেকে অসাধারণ অন্যরকম মনে হয়েছে। ভালো মনে হয়েছে। অনেক বেশি ম্যাচিউরিটি এসেছে। ভাষার প্রতি অনেক দখল আছে। কিন্তু সেই দখলদারি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও যেন একটা জমিদারি ফলানোর প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। কবি যদি এগুলোর থেকে নিজেকে নিবৃত করতে পারে, আরও সাধনায় মগ্ন হতে পারে, আমার মনে হয় সেটা খুব ভালো হবে। আমি আগেই বলেছি এটা আমার বিশ্লেষণগত দোষ হতে পারে, কারণ আমি এই রকম একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে রেখেছি যে পাঁচ সাত লাইনের বেশি কবিতা এখন আর লিখিনা, এবং এক একটা লাইনে হয়তো দুটো শব্দ আছে, কোন লাইনে আবার একটা শব্দও থাকে। এইটা কিন্তু একটা দোষ কবির , যে সে যা লেখে সে মনে করে পৃথিবীটা তাই লিখুক। তা তো হয়না! এটা তো হতে পারে না। এটা অ্যাবসার্ড থট। কিন্তু তার একটা প্রভাব আমার মধ্য পড়ে গেছে এটা আমি বুঝতে পারছি। থ্যঙ্কিউ।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

আমি একটু বলবো?

 

উমাপদ কর

হ্যাঁ, বল।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

তোমাকেই প্রশ্ন করছি। তুমি কি অতিকথন প্রসঙ্গে সেলসিয়াস কবিতার কথা কিছু বলেছো?

 

উমাপদ কর

না।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

কারণ, সেলসিয়াস কবিতার তিনটে পার্ট – একলাইন, একলাইন আর তিনলাইন।

 

উমাপদ কর

সেলসিয়াস কবিতা নিয়ে নয়, আমি কাব্যগ্রন্থের অন্য কিছু লেখা প্রসঙ্গে বলেছি।

 

চিত্তরঞ্জন হীরা

ঠিক আছে, বাকিটা যা বলেছ, ঠিক আছে। বাড়তি কথা আমি আর বলছি না।

 


Post a Comment from facebook

1 Comments

  1. অ্যামিবার ক্ষণপদের মত পার্থদার কবিতা ক্ষণস্থায়ী কি না তার জবাব সময় দেবে। তবে কবি সেসব নিয়ে ভাবতে নারাজ, এটাই আশাপ্রদায়ী। যাইহোক, খুব মূল্যবান মতামত পেলাম এই আসর থেকে। আজ বুঝলাম আমিও কবিতা দেখে যত আনন্দ পাই, শুনে ততটা পাইনা। বিজ্ঞানের শব্দবন্ধ কবিতায় সাবলীল ভাবে প্রয়োগের অনন্য ধারায় আমি অবাক হই বারংবার। শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে কবিতা খটমট লাগে ঠিকই কিন্তু তাকে কেন এড়িয়ে যাবো সেটাও এই বৈঠকের পর আমাকে আর তাড়া করতে পারবে না।

    ReplyDelete

Post a Comment