Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।
͢──────

রোয়াক অবসরে কবিতা বিষয়ক গদ্য

কবিতার ধ্বনি, কবিতার প্রাণ, কবিতার নির্মাণ

উমাপদ কর

 

ভূমিকাঃ  বিষয়- কবিতার ধ্বনি, কবিতার প্রাণ, কবিতার নির্মাণ। কবিতার কথাটিকে কমন নিলে শব্দবন্ধটি দাঁড়ায় কবিতার ধ্বনি, প্রাণ, নির্মাণ। এখন ‘কবিতার ধ্বনি’ কথাটা কতটা সুপ্রযুক্ত সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে যথেষ্ট। কেননা কবিতা পাঠ করলে এবং ধ্বনির বিজ্ঞান-তত্ত্ব মানলে ধ্বনি উদ্‌গীরণ অবশ্যাম্ভাবী। ফলে কবিতা-অকবিতা-গদ্য-পগদ্য সর্বক্ষেত্রে ধ্বনি কমন বা সাধারণ। আমার মনে হয় না এটাই আমার আলোচ্য। বরং আলোচ্যটা হল, কবিতায় ধ্বনি। তথা কবিতায় ধ্বনি সংক্রান্ত নানাদিক। এবারে কবিতার প্রাণ-- এটা দুভাবেই ব্যবহৃত ও প্রযুক্ত হতে পারে। মানে কবিতার প্রাণ বা কবিতায় প্রাণ। কিন্তু আবার যদি আমি বলি, কবিতায় নির্মিতি তাহলে বিষে বিষক্ষয় হয় বলে আমার মনে হয়। কবিতা-তো নির্মিতিই, সেক্ষেত্রে কবিতায় নির্মিতি জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে তো থাকবেই। তাই এক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা ঠিক পথটিই বাতলেছেন— কবিতার নির্মাণ। তাহলে আমার আলোচ্য বিষয়টি দাঁড়ালো— কবিতায় ধ্বনি, প্রাণ ও কবিতার নির্মাণ, বা কবিতায় ধ্বনি এবং কবিতার প্রাণ ও নির্মাণ। একটু কি জটিল করার চেষ্টা করছি? মোটেও না। চেষ্টা করলাম, বক্তব্য উপস্থাপনের সাজানোটাকে।


কবিতায় ধ্বনি -  খুব সহজভাবে ভাবলে কবিতায় দুটো দিক খুবই প্রাধান্য পায়, এক) দৃশ্যতা। দুই) শ্রাব্যতা। ভাবনা হলো কবিতার উৎসমুখ। সেই ভাবনার স্ফুরণ, সেই ভাবনাজনিত অনুভবমালার লিপিত রূপটি হলো কবিতা, যা মূলত নিরাকার। আকার যেটা আমরা আপাতভাবে প্রত্যক্ষ করি, সেটা তো কবিতা নয়, কবিতাটা আড়ালেই থাকে। এখন উৎসমুখ থেকে অপসারি ভাবনামালার যে ভ্রমণ, তাতে নির্মাণপ্রকল্পটি ভর করা থাকে ওই দৃশ্যতা ও শ্রাব্যতার ওপরেই। এখানে দৃশ্যতা বা ভিজুয়ালিটি নিয়ে আমার বলার কথা নয়, বলবও না। আমি শ্রাব্যতায় চলে আসব। এতাবধিকাল কবিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দ-নির্ভর।(ভিজুয়াল পোয়েট্রি, ম্যাথমেটিকাল পোয়েট্রি,কবিতা-গ্রাফ ইত্যাদিকে বাইরে রেখে)। শব্দ ও শব্দবন্ধ গেঁথেই কবিতার নির্মাণ। শব্দ ধ্বনিসৃষ্ট, শব্দের আদিতে ধ্বনি। আবার ধ্বনি-বিজ্ঞানীদের মতে ধ্বনির সৃষ্টি নানাভাবে হতে পারে। সেই ধ্বনিই যে শব্দে রূপান্তরিত হবে বা হয়ে শব্দ প্রাথমিক একক (স্বনিম) হিসেবে ভাষা সৃষ্টি করবে তা কিন্তু নয়। ভাষা হল কেবলমাত্র মানুষের বাগ্‌যন্ত্রের (মুখ, মুখগহ্বর, নাসিকা, তালু, দাঁত, ওষ্ঠ, কণ্ঠ, ভোকাল কর্ড, ফুসফুস, শ্বাস-প্রশ্বাস) সাহায্যে উচ্চারিত কতকগুলো ধ্বনিগত প্রতীকের (Vocal symbol) সমষ্টি। ফলে যে কোনও রকম ধ্বনিই ভাষা নয়। যেমন, জীবজন্তুর কণ্ঠস্বর, বস্তুতে বস্তুতে সংঘর্ষ বা পতনজনিত ধ্বনি, মানুষের হাততালি, পাগলের প্রলাপ, বা শিশুর চিৎকার ভাষা নয়। দুটো কারণে, এখানকার কিছু মানুষের বাগযন্ত্র নিসৃত নয়, আবার কিছু মানুষের বাগযন্ত্র নিসৃত হলেও তা বস্তু বা ভাব বা ভাবনার প্রতীক নয় বলে।


মানুষ, বাগযন্ত্র, ধ্বনি, শব্দ, ভাষা নিয়ে কিছুটা বলা গেল। আরেকটা দিক তুলে না-ধরলে আলোচনাটায় এগোনো যাবে না। ভাষার সঙ্গে মানুষের মনের, আর আত্মার যোগ অবিচ্ছেদ্য। ভাষার উৎস মানুষের মনে, মনের চিন্তারাজির প্রকাশের তাগিদেই ভাষার জন্ম। ভাষা হচ্ছে মানুষের ধ্বনিমাধ্যম প্রকাশ। শুধুমাত্র মানুষের জৈবিক মনোভাব যেমন ক্ষুন্নিবৃত্তি, রমনবৃত্তি, সাধারণ যোগাযোগ, ইত্যাদির জন্য ভাষার জন্ম হয়নি। সেটা ভাষা ছাড়া অন্যভাবেও করা যেত। মনীষী প্লাতো সুন্দর করে, কিছুটা কবিত্ব মিশিয়ে বিষয়টা বলেছেন— “চিন্তা ও ভাষা মূলত একই; পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, চিন্তা হল আত্মার নিজের সঙ্গে নিজের নীরব কথোপকথন, আর যে প্রবাহটি আমাদের চিন্তা থেকে ধ্বনির আশ্রয়ে ওষ্ঠের মধ্যে দিয়ে বয়ে আসে তাই হল ভাষা”। ভাষাসৃষ্টিতে মানুষ অন্যসব প্রাণীর চেয়ে স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্টপূর্ণ। এ এক অভিজ্ঞান। এটা হল বাহ্যিক। আর মূল অভিজ্ঞান হচ্ছে তার মন, তার অন্তর, তার আত্মা; আর এরই বাহ্যপ্রকাশ হচ্ছে ভাষা। এ জন্যই আধুনিকতম ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি মনে করেন—“ In the technical sense, linguistic theory is mentalistic, since it is concerned with discovering a mental reality underlying actual behavior.” অর্থাৎ মানুষের ভাষার প্রকাশরূপের অন্তরে আছে যে অর্থসম্পদ, তার বাহ্যিক গঠনের নীচে রয়েছে যে গভীরতর গঠন, এবং বাহ্য ব্যবহারের অন্তরে নিহিত আছে ভাবকেন্দ্র-স্বরূপ যে মন, তাকে আবিষ্কার করাই ভাষাজিজ্ঞাসার মূল লক্ষ্য।


এখন মানুষের মনের যে অনন্যসুলভ সম্পদ, সেই মনের তিনটি মূল উপজীব্যতা—ক) চিন্তা (Thinking) খ) সংকল্প (Willing) গ) অনুভব (Feeling)। এরমধ্যে এই অনুভব ভাগটি যেমন সূক্ষ্ম, যেমন কোমল বা নরম, তেমনি জটিল আর রহস্যময়। এই বৃত্তিটি যখন চালিত হয় সৌন্দর্যের পূর্ণরূপ বা বিপরীত বা অপর কিছু সন্ধানে, তখন তার ভেতরের সৃজনীশক্তির স্ফুরণ ঘটে, সৃষ্টি হয় সৌন্দর্য, ভয়ালো সৌন্দর্য। ফলশ্রুতিই হল শিল্পসৃষ্টি। একটা ভাগ সাহিত্য, যার একভাগে পদ্য (Verse) পরে কবিতা (Poetry)।


আমি কি আলোচনাটা ঘুলিয়ে দিলাম? না। আসলে কবিতায় ধ্বনি এটা বলতে গেলে আমাকে ধ্বনি থেকে কবিতায় আসতেই হবে। তাই ধ্বনি, শব্দ, ভাষা, মন, অনুভব, শিল্প ইত্যাদি ঘুরে আমাকে কবিতায় আসতে হল। এবারে কবিতায় ধ্বনির প্রভাব, ধ্বনির মাধুর্য, ধ্বনির রকমফের ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার জায়গায় আমরা পৌঁছে গেছি। দেখি তার প্রত্যক্ষতা। দেখতে গিয়ে আমি মূলত বাংলাভাষার কবিতায় মনোনিবেশ করব। তার আগে একটা ব্যক্তিগত কথা বলে নিই। কৈশোরে সংস্কৃতে চন্ডীপাঠ, বেদ উপনিষদের কিছু সুক্ত উচ্চারিত হতে শুনতাম। যেমন- “সহনাববতু সহনৌভনক্তু সহবীর্যং করবাবহৈ/ তেজস্বীনাবধিতামস্তু, মা বিদ্বিষাবহৈ।।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ)। বা “যো দেবো অগ্নৌ যো অপসু যো বিশ্বং ভুবনাবিবেশ/ যো অষধীষু যো বনস্পতি তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ।।” (শেতাশ্বতর উপনিষদ)। এর অর্থ ভাব-ভাবনা কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু শুনতে বা নিজের কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করে পড়ে শুনতে ভালো লাগত। অদ্ভুত সুন্দর একটা ফিলিংস হত। কেন হত? এই শব্দসমূহের চিহ্ন তো আমার জানা নেই, এই ভাষার প্রতীক তো আমার জানা ছিল না। তবু ভালো লাগত, আজও লাগে। লাগে, কারণ এর ধ্বনিমাধুর্য। এখানেই শ্রাব্যতার বিষয়টা লুকিয়ে আছে। সুতরাং এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, পদ বা পদ্যে ধ্বনির প্রভাব যথেষ্ট, যে প্রভাব তাকে মাধুর্যে ভরে দিচ্ছে। কানে শুনতে মনের আরাম ও আনন্দ হচ্ছে।


আসি চর্যাপদে। বৌদ্ধ-দোঁহা। সাধনতন্ত্রের পদ। প্রাচীনতম বাংলাভাষা, বা বাংলাভাষার আদিরূপ। একটা পদ রেফারেন্স হিসেবে বলি—

     “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ।।

     দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ। লুই ভনই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ ।।

     সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই। সুখেদুখেতেঁ নিচিত মরিআই ।।

     এড়িএউ ছান্দক বান্ধ কারণক পাটের আস। সুন্নপাথ ভিড়ি লাহু রে পাস

     ভণই লুই আম্‌হে ঝাণে দিঠা। ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা ।।”       (লুইপা। পদ-১)

 

এখানেও কিন্তু ধ্বনির গুঞ্জরণ আমরা পদে পদে পাচ্ছি। যে কোনো ভাষাই ভাষাতাত্ত্বিক ও ভাষাবিজ্ঞানীরা তিনটি দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষন করে তার বৈশিষ্ট্য ও অগ্রসরমানতার কথা বলে থাকেন। সেগুলো হলো তার ধ্বনি-তাত্ত্বিক রূপ, রূপতত্ত্বের দিক এবং ছন্দ-রীতিগত অবস্থান। এখানে রূপ-তত্ত্ব নিয়ে বলার কোনো অবসর নেই। কিন্তু সাধারণ পাঠেও, ধ্বনি-তত্ত্বের দিকে এই সময়ের শব্দ গঠনে স্বরবর্ণের উচ্চারন প্রাধান্য বেশি, বিশেষত অ এবং আ ধ্বনি। কাআ, করিঅ, পুচ্ছিঅ, সঅল, সমাহিঅ, মানে পদান্তে স্বরবর্ণের প্রয়োগ। স্বরমধ্যবর্তী একক মহাপ্রাণধ্বনি প্রায়ই হ-কারে পরিণত, যেমন মহাসুহ। নাসিক্য ধ্বনির বহুল ব্যবহার, যেমন সুখেদুখেতেঁ। পাশাপাশি একাধিক স্বরধ্বনির অস্তিত্ব, যেমন— মরিআই, এড়িএউ, করিঅই ইত্যাদি। ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য পদমধ্যে ‘হ’ ধ্বনির সংরক্ষণ, যেমন- খনহ, করহ ইত্যাদি। এসব বাদে পাঠকালে, উচ্চারিত ধ্বনিসমূহের ফলে একটা আবেশ কিন্তু তৈরি হচ্ছে। আর আছে ছন্দ-রীতিগত বৈশিষ্ট্যজনিত ধ্বনির স্পন্দন। “কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল”। এখানে শুধু অন্ত্যমিলই না। পঞ্চ বি ডাল / চঞ্চল চীএ। যে ধ্বনি সাযুয্য তৈরি করছে তা উল্লেখ করার মতো। আবার “এড়িএউ ছান্দক বান্ধ কারণক পাটের আস। সুন্নপাথ ভিড়ি লাহু রে পাস” এখানে ছান্দক বান্ধ কারণক পাশাপাশি এবং পরে সুন্নপাথ শব্দ বসে একটা নাসিক্য বর্ণের অনুপ্রাস তৈরি করে ধ্বনি মহিমা ছড়িয়েছে। চর্যায় ১৬ মাত্রার পাদাকুলক, ২৪ মাত্রার দোহা আর ৩০ মাত্রার চউপইআ। অর্থাৎ রীতিটি মাত্রাভিত্তিক। পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে।


 

বাংলাভাষার মধ্যযুগকে নানাকারণে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। তার একটা কারণ অবশ্যই ভাষার ধ্বনি-তত্ত্বের রূপ পার্থক্যে। তো আদিমধ্য যুগে বড়ু চণ্ডীদাস একমাত্র আবিষ্কৃত প্রতিনিধি। এটা হচ্ছে  অপভ্রংশকাল। কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। বড়ো কাব্য। একটা ছোট্ট পদ বলি--

    “কে না বাঁশী বাএ  বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।

    কে না বাঁশী বাএ  বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।

    আকুল শরীর মোর  বেআকুল মন।

    বাঁশীর শবদেঁ মো   আউলাইলোঁ রান্‌ধন। ১

    কে না বাশীঁ বাএ  বড়ায়ি সে না কোন জনা।

    দাসী হআঁ তার    পাএ নিশিবোঁ আপনা।। ধ্রু”      (১১ বংশী খণ্ড থেকে)

এখানে ধ্বনিগত দিক থেকে দেখা যাচ্ছে নাসিক্যধ্বনির প্রাচুর্য আগের থেকে বেড়ে গেছে। যেমন- শবদেঁ, আউলাইলোঁ, হআঁ, নিশিবোঁ ইতাদি। আরেকটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আ-কারের পরস্থিত ই-কার এবং উ-কার ধ্বনির ক্ষীণতা, বড়ায়ি, পাএ ইত্যাদি। সাধারণ উচ্চারণগত পাঠে অন্ত্যমিল ছাড়াও একটা সুরেলা আবেশ সৃষ্টি এই পদের ভাষাবিন্যাসে রাখা আছে। “আকুল শরীর মোর  বেআকুল মন।/ বাঁশীর শবদেঁ মো   আউলাইলোঁ রান্‌ধন।” একটা ধীর লয়, একটা মাধুর্যকে কানে ভরে দিতে সাহায্য করছে। এখানে পয়ার ছন্দ পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেটাও ধ্বনির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।


অন্ত্যমধ্যযুগের দুজন কবিকে এ-বিষয়ে তুলে আনব, সময়বিচারে আর পদ বা পদ্যে ধ্বনি সন্নিবেশের রকমফেরে। প্রথমে কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। “চণ্ডীমঙ্গল” প্রণেতা।

           “বেণে বড় দুষ্টশীল,       নামেতে মুরারিশীল,

                    লেখা জোখা করে টাকা কড়ি।

             পাইয়া বীরের সাড়া,      প্রবেশে ভিতর পাড়া,

                    মাংসের ধারয়ে দেয় বুড়ি।।

                   --খুড়া খুড়া ডাকে কালকেতু।

             কোথা হে বণিকরাজ,      বিশেষ আছয়ে কাজ,

                     আমি আইলাম সেই হেতু।।

             বীরের বচন শুনি,       আসিয়া বলে বেণ্যানী,

                     আজি ঘরে নাহিক পোদ্দার।

             প্রভাতে তোমার খুড়া      গিয়াছে খাতক-পাড়া,

                      কালি দিব মাংসের উধার।”

এই শব্দ, শব্দবন্ধ, ভাষা আমাদের আগের চেয়ে অনেক চেনা। অর্থাৎ আজকের মান্যতাপ্রাপ্ত বাংলাভাষার কাছাকাছি। এখানে উচ্চারণ করে পাঠকালে যা কানে আসে তাতে ধ্বনিগত ব্যাপক কিছু প্রভাব লক্ষ করা যায় না। ত্রিপদীতে লেখা, কাহিনি বর্ণনা মুখ্যত। ত্রিপদী ছন্দ-রীতি নেওয়ায় পঙক্তি মধ্যের অন্ত্যমিলটার সঙ্গে পাঠের একটা সহজগম্যতা আছে। কিন্তু কোথাও নাদের তেমন উচ্চা-বচ দেখা যাচ্ছে না। সামান্য যা নাটকীয়তা আছে। এবং সেই নাটকীয়তাকে ঘিরে যতটা ধ্বনির খেলা।  

 

অন্ত্যমধ্যযুগের শেষ কবি রায় গুণাকর ভারত চন্দ্র। “অন্নদা মঙ্গল” প্রণেতা। ‘বিদ্যাসুন্দর’ প্রণে্তা।

ক) গনেশ বন্দনা

   “হেলে শুণ্ড বাড়াইয়াঃ সংসার সমুদ্র পিয়াঃ খেলাচ্ছলে করহ প্রলয়।

    ফুৎকারে করিয়া বৃষ্টিঃ পুনঃ কর বিশ্বসৃষ্টিঃ ভাল খেলা খেল দয়াময়।।

    বিধু বিষ্ণু শিবা শিবাঃ ত্রিভুবন রাত্রি দিবাঃ সৃষ্টি পুনঃ করহ সংহার।

    বেদে বলে তুমি ব্রহ্মঃ তুমি জপ কোন্‌ ব্রহ্মঃ তুমি সে জানহ মর্ম্ম তার।।”

 

খ) শিবের দক্ষালয়ে গমন

        “মহারুদ্ররূপে মহাদেব সাজে। ভভম্ভম ভভম্ভম শিঙ্গা ঘোর বাজে।।

        লটাপট জটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা। ছলচ্ছল টলট্টল কলক্কল তরঙ্গা।।

        ফণাফণ্‌ ফনাফণ্‌ ফণিফণ্ণ গাজে। দিনেশপ্রতাপে নিশানাথ সাজে।।

        ধক্‌ধ্বক্‌ ধক্‌ধ্বক্‌ জ্বলে বহ্নি ভালে। ববম্বম্‌ ববম্বম্‌ মহাশব্দ গালে।।”

 

গ)   শিব বিবাহ

        “জয় জয় হর রঙ্গিয়া

         করবিলসিত নিশিত পরশু

         অভয় কুরঙ্গিয়া।।

 

         লক লক ফণী জটবিরাজ

         তক তক তক রজনিরাজ

         ধক ধক ধক দহন সাজ

         বিমল চপল গঙ্গিয়া।

 

         ঢুলু ঢুলু ঢুলু নয়ন লোল

         হুলু হুলু হুলু যোগিনীরোল

         কুলু কুলু কুলু ডাকিনীরোল

         প্রথম প্রথম সঙ্গিয়া।।

 

        ভবম ভবম ববম ভাল

        ঘন বাজে শিঙ্গা ডমরু গাল

        রুদ্র তালে তাল দেই বেতাল

        ভৃঙ্গী নাচে অঙ্গভঙ্গিয়া।

       

        সুরগণ কহে জয় মহেশ

        পুলকে পুরল সকল দেশ

        ভারত যাচত ভকতিলেশ

        সরস অবশ অঙ্গিয়া।।”

 

গ)   বিদ্যার রূপবর্ণন

     “বিনানিয়া বিনোদিয়া বেণীর শোভায়।

      সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়।।

      কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা।

      পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা।।

      কি ছার মিছার কাম ধনুরাগে ফুলে।

      ভুরুর সমান কোথা ভুরুভঙ্গে ভুলে।।”

এই যে আমি তাঁর কাব্যের কিছু অংশ পড়লাম, তা থেকে স্পষ্ট, এই কবির পদ আগের যে কোনো কবির থেকে আলাদা। এখানে মূল পার্থক্যটা কিন্তু রচিত হয়েছে এই ভাষার ধ্বনিগুণে। তাঁর কাব্যভাষায় যেটা প্রথমেই লক্ষ্যনীয় তা হলো, শব্দভাণ্ডারের বিস্তৃতি। প্রচুর নয়া শব্দের প্রয়োগ তিনি করেছেন। দ্বিতীয়ত সংস্কৃত ভাষার ছন্দ ও অলংকার (শব্দালংকার ও অর্থালংকার) বাংলাভাষায় সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। তৃতীয়ত শব্দজোড় তৈরি করেছেন বেশ কিছু। বেশ কিছু দেশি এবং সামান্যকিছু বিদেশি শব্দ এনেছেন। চতুর্থত— যুক্তবর্ণের ব্যবহার করেছেন কম। ক্রিয়াপদ ব্যবহারে যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। পঞ্চমত- অনুকার শব্দের প্রচুর ব্যবহার করেছেন। এই শব্দপ্রয়োগে কবিতায় ধ্বনির উদ্ভব হয়। আসলে অনুকার শব্দে ধ্বন্যাত্বক ব্যঞ্জনা আছে। যেমন, ‘ভভম্ভম’, ‘লটাপট’, ‘জটাজুট’, ‘ছলচ্ছল’, ‘টলট্টল’, ‘কলক্কল’, ‘ফণাফণ্‌’ ‘ফণিফণ্ন’, ‘ধ্বক্‌ধ্বক্’, ‘ববম্বম্‌’, ‘লক লক’, ‘তক তক তক’, ‘ধক ধক ধক’, ‘ঢুলু ঢুলু ঢুলু’, ‘হুলু হুলু হুলু’, ‘কুলু কুলু কুলু’, ‘ভবম ভবম ববম’ ইত্যাদি। এসব শব্দের মধ্যে প্রচলিত শব্দ যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁর তৈরি করা শব্দও। যেমন ‘ভভম্ভম’, ‘টলট্টল’, ‘কলক্কল’ ‘ফণিফণ্ন’, ‘ববম্বম্‌’ ইত্যাদি ধ্বন্যাত্বক শব্দের ব্যবহার এই প্রথম বলে মনে হয়। আবার ‘ঢুলু’, ‘হুলু’, ‘কুলু’ ইত্যাদি শব্দগুলো তিনবার করে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা এসবের দুবার প্রয়োগ আগে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তিনবার ব্যবহারে এক আলাদা মাত্রা পেয়েছে। একদিকে পঙক্তিতে দুটো অক্ষর বাড়িয়ে ছন্দের বিষয়টি ঠিক রাখা হয়েছে, অন্যদিকে তিনবার ব্যবহৃত হয়ে ব্যঞ্জনায় এক ভিন্নমাত্রার উদ্ভব ঘটিয়েছে। এইভাবে কিছু নিজসৃষ্ট অনুকার শব্দ এবং প্রচল অনুকার শব্দের ব্যবহারে ভাষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধ্বনিপ্রধান হয়ে উঠেছে। সব শব্দেরই যে অর্থ রয়েছে, (শব্দের অর্থ হয় না। শব্দ কিছুকে রেফার করে) তা নয়, কিন্তু ধ্বনিউদ্রেকে তাঁর উদ্দেশ্যটি সম্পন্ন হয়েছে। আবার সব সময় যে ধ্বনিমাধুর্য বজায় থেকেছে, তা বলা যাবে না, কিন্তু বাংলা কাব্যে এই প্রয়োগটি যথেষ্ট নতুনত্বের দাবি করে।

 

অনুকার, অনুপ্রাস, যমক, উপমা, বিরোধাভাস, ব্যজস্তুতি ইত্যাদি শব্দালংকার ও অর্থালংকার সফলভাবে প্রয়োগ করায় গঠিত ভাষাটি সহজেই এক কাব্যভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। পদ্য রচনায় ছন্দের এক শক্তিময় ভূমিকা আছে। কবি ছন্দে এমনই পারঙ্গম যে তাঁর ভাষায় একটি স্বাভাবিক গতি আছে। ছন্দ— মূলত চোদ্দ অক্ষরের পয়ার আর ত্রিপদী। ত্রিপদীতে বিভিন্ন রকম অক্ষর সজ্জা। যেমন ৮-৮-১০। আবার ৬-৬-৮। এর ফলেও শ্রাব্যতায় রকমফের ঘটেছে। তাঁকে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন- যেমন—ক) ডঃ সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি বলেছেন—‘ছন্দের রাজা’, খ) মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন—‘ম্যান অফ দা এলিগেন্ট জিনিয়াস’, গ) বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—‘ফাদার অফ মডার্ণ বেঙ্গলি’, ঘ) তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যকে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন – ‘রোমান্টিক স্যাটায়ার’, ঙ) স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—‘রাজকণ্ঠের মণিমালা’। চ) সংগ্রাহক এবং প্রাবন্ধিক দীনেশ চন্দ্র সেন বলেছেন—‘ভাষার তাজমহল’। তাঁর ভাষাগঠনের ক্ষেত্রে তিনি ধ্বনির দিকটিকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছেন। পদ পদ্যে এত ধ্বনিতরঙ্গের খেলা বাংলায় এর আগে আমরা আর ততটা পাই না।


আধুনিক যুগে আসি। আমি ঈশ্বর গুপ্তকে দিয়ে শুরু না-করে শুরু করব মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তুলে ধরে— মেঘনাদ বধ কাব্য শুরু হচ্ছে--

ক) “সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি

    বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে

    অকালে, কহ, হে দেবী অমৃতভাষিণী,

    কোন্‌ বীরবরে বরি সেনাপতি পদে,

    পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃ কুলনিধি

    রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা

    ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে—অজেয় জগতে—

    উর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?”

বাংলা কাব্যসাহিত্যে মাইকেল সব যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন, তা আমরা জানি। যেমন অমিত্রাক্ষর ছন্দের সূচনা, চতুর্দশপদী রচনা, কাব্যে বীর-রসের সৃষ্টি। ইত্যাদি। আমরা ধ্বনি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলি। এই যে কাব্যভাষার প্রবর্তন তিনি করলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতি পঙক্তিতে ১৪ অক্ষরের সজ্জা। ৮+৬। কোনো অন্ত্যমিল নেই। পঙক্তির মধ্যে বিভিন্ন যতি চিহ্ন। প্রায় সমস্তই তৎসম শব্দ নির্বাচন, সামান্য কিছু তদ্ভব, দিশি শব্দ নেই বললেই চলে, বিদেশি শব্দ নেইই। এই নিয়ে প্রচণ্ড গতিশীল এক ভাষা। শব্দ নির্বাচন করেছেন এমন যেখানে ধ্বনি-ব্যাঞ্জনা আছে, এমনভাবে শব্দচয়ন করা হয়েছে যাতে একটা উচ্চগ্রাম বজায় থাকে, অন্ত্যমিল না-থাকলেও সুর-স্বর-তাল-লয় একটা গতিময়তায় থামতে দিতে চায় না। সাধারণত অধিক যতিচিহ্ন বাক্যে থাকলে বারবার নানাভাবে থামার কারণে ভাষার গতি কমে, কিন্তু এখানে আমরা ব্যতিক্রম লক্ষ করি। উল্টোদিকে বিভিন্ন যতিচিহ্নের জন্য শ্বাসাঘাতের পরিবর্তনের ফলে ধ্বনির প্রাধান্য বেড়ে যায়। শ্রাব্যতার ক্ষেত্রে একটা বিশেষ অনুভব সৃষ্টি করে গায়ের লোম খাড়া করে দেয়। আবার বেশ কিছু শব্দজোড় থাকায় দীর্ঘকালীন শ্বাসাঘাতে ধ্বনির লম্বতা বৃদ্ধি পায় এবং তার জন্য ধ্বনির মাত্রা অন্যরকমভাবে অনুভূত হয়। যেমন—অমৃতভাষিণী, রাক্ষসভরসা, উর্মিলাবিলাসী, ইত্যাদি।

 

এই কবিই যখন চতুর্দশপদী রচনা করছেন, তখন ভাষাটা প্রায় একই রেখে তার গতিশীলতা কমিয়ে আনছেন। একটা ভিন্নধর্মী অন্ত্যমিলও প্রয়োগ করছেন। পঙক্তির মধ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার কমিয়ে আনছেন। শব্দ নির্বাচন প্রায় একই ধরনের রেখে, বয়নে ভিন্নতা এনে একটা ধ্বনি-সুষমা এনেছেন। আমরা আগের গতিশীলতায় আর কবিতাটা পড়তে পারছি না। ফলে শ্রাব্যতায় ভিন্নতা আসছে। একটা পড়ি--

 কবি

“কে কবি--- কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে--- তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!”

আবার চতুর্দশপদীতে ধ্বনিচলন অন্যরকমও দেখি। এখানে ভাব-ভাবনার সঙ্গে তাল রেখে ভাষার গতি আরও শ্লথ। আর একটা সুরেলা মনোগ্রাহী আবহের ধ্বনি। যেমন-

“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/  দীন যে, দীনের বন্ধু !-- উজ্জল জগতে/ হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।”

১৬ অক্ষরের পয়ারে আরও ভিন্নতা। একটু এলিয়ে চলা ধীরলয়ের গতি। উচ্চারণজাত ধ্বনি এখানে যেন কানের চেয়ে মনে বাজে বেশি। যেমন-

“জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে / চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে!”

 

এক লাফে চলে আসব রবীন্দ্রনাথে— বাংলা পদ্য ও কবিতার এক দিকপাল। তাঁকে নিয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তাঁর কবিতার শ্রাব্যতাগুণ দৃশ্যতাগুনের সঙ্গে এমন মিলেমিশে থাকে, যে কাউকে ছেড়ে কাউকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া যায় না। তবু ধ্বনিগুণ সমন্বিত কিছু কবিতাংশ আপনাদের সামনে পাঠ করতে চাই, যেখানে এতাবধিকাল উল্লেখ করা আমার পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণের আর দরকার পড়বে না। শুধু এক-আধটু ছোঁয়া দিলেই চলবে।

ক) “সকল বেলা কাটিয়া গেল, বিকাল নাহি যায়।

    দিনের শেষে শ্রান্তছবি   কিছুতে যেতে চায় না রবি,

    চাহিয়া থাকে ধরণী পানে— বিদায় নাহি চায়।।”

 

 খ) গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

      কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

      রাশি রাশি ভারা ভারা  ধান কাটা হল সারা,

      ভরা নদী ক্ষুরধারা  খরপরশা—

      কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।।” 

 

 গ)  আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর

      আবরণরাশি করিয়া দে দূর,

      করি লুন্ঠন অবগুন্ঠন-বসন খোল্‌।

                  দে দোল্‌ দোল্‌।।

 

       প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ

       চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয় লাজ,

       বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে ভাবে বিভোল।

                       দে দোল্‌ দোল্‌।

       স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ দুটো পাগল।

                       দে দোল্‌ দোল্‌।।” 

এখন, তাঁর প্রথম দিককার এইরকম তিনটে কবিতাংশ উচ্চারণ করে পাঠকালে আপনাদের শ্রাব্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মননে যে অভিঘাত তৈরি করল, আমার মনে হয়, আপনারা একমত হবেন যে অষ্টসুরের প্রেক্ষিতে প্রথমটা যদি প্রথম সুরের ‘সা’ হয়, তাহলে দ্বিতীয়টা হলো চতুর্থ সুরের ‘মা’, এবং নিশ্চিতভাবে তৃতীয়টা অষ্টসুর ‘সা’। অর্থাৎ ক্রম উর্ধ্বমুখী। ধীর, মধ্য, ও গতিশীল চলন ও ধ্বনি সৌকর্য।  

 

আবার যখন মধ্যপর্বের কবিতাংশ পড়ব, সেখানে খেয়াল করব শব্দে ধ্বনি-ঝংকার। মৃদু, মধ্য, উচ্চ। দেখব যুক্তাক্ষরের শব্দ-প্রয়োগ বেশি। এবং বাংলা যুক্তাক্ষর উচ্চারণে যে ধ্বনিসৃষ্টি হয়, তার শ্রাব্যতা ভিন্ন। এটাকে তিনি তারিয়ে তারিয়ে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়।

 

“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,                                                                                                               সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,                                                                                                      যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,                                                                          যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,                                                                       মহা-আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,                                                                       দিক্‌-দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা—                                                                                                 তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,                                                                                               এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।।”              

 

“আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,

 আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,

 আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে,

 আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।।”

“কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।

         তারি রথ নিত্যই উধাও

      জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,

         চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।”

আশা করি এই তিনটি কবিতাংশের ধ্বনিগুণের পার্থক্যও আপনাদের বিবেচনায় ধরা পড়ছে।

 

আর শেষ পর্বে এসে ভাব-ভাবনা-চিন্তা-চেতনার সঙ্গে তালমেলানো স্বরক্ষেপনে সৃষ্ট ধ্বনিগুণ। সে বেশ কিছুটা অন্যরকম। ভাবনার সঙ্গে তালমেলানো স্বরক্ষেপন। যেমন- প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ভাষাবিন্যাসে উচ্চগ্রামের নাদ, গতিশীল, কখনো নেমে এসেছে খাদে। আবার সংবেদনের ক্ষেত্রে ভাষাগতি কিছুটা শ্লথ কিছুটা মায়াময়, ফলে ধ্বনিপ্রক্ষেপণে সেই উচ্চগ্রাম আর নেই, কিছুটা এলিয়ে পড়া, সুখশ্রাব্য। আবার যখন ভাবেভাবনায় প্রকৃতির সঙ্গে নিত্যতা কাজ করে বা ভবিষ্যত স্বপ্ন কল্পনায় মন টানটান হয়ে ওঠে, তার ভাষা হয়ে ওঠে প্রত্যয়ী দৃঢ়। ধ্বনিগুণও সেভাবে কানে ঢালতে থাকে তার বিচিত্র রূপ।

 

ক)       হায় ছায়াবৃতা,

        কালো ঘোমটার নীচে

       অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ

                  উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।

     এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে

         নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে

         এল মানুষ-ধরার দল

       গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।

          সভ্যের বর্বর লোভ

               নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।

       তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাস্পাকুল অরণ্যপথে

            পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে;

       দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়

             বীভৎস কাদার পিন্ড

       চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।”

এখানে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। পাঠ গতিময় হয়ে ঝংকার তোলে, আবার খাদেও নামে।

 

খ)           হঠাৎ সন্ধ্যায়

          সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,

                সমস্ত আকাশে বাজে

                     অনাদি কালের বিরহবেদনা।

                           তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে

                               এ গলিটা ঘোর মিছে,

                       দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো।

                              হঠাৎ খবর পাই মনে

                         আকবর বাদশার সঙ্গে

                          হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।

                                   বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে

                         ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে

                         এক বৈকুন্ঠের দিকে।”

অন্ত্যমিলহীন, কিন্তু সুখশ্রাব্য, ধ্বনিতরঙ্গ একটা লয়ে চলতে চলতে একটা বিশেষ গ্রাফ আঁকতে থাকে।  

গ)         আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর—

            ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক, আগুনের ডাক,

                পাঁজরের উপরে আছাড়-খাওয়া

                    মরণ-সাগরের ডাক,

                 ঘরের শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক।

                    যেন হাঁক দিয়ে আসে

                        অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে

                            পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি,

                     ছিনিয়ে নেবে, ভাসিয়ে দেবে বুঝি।

             ………        ……………         …………

          দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত করে ফেলি

                 নেই এমন বুকের পাটা;

              কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে

                    কাঁদতে শুধু জানি

                 জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে।”

এ-দুটিতে ধ্বনিপ্রক্ষেপণে উচ্চগ্রাম অনুপস্থিত। কিছুটা এলিয়ে পড়া, শ্লথ।

ঘ) বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল

           কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়—

      সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ;

                তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু ক’রে

           হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে;

      হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল

            শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।

 

   আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া

        ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে

   চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;

          বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে

                 অকস্মাত কল্লোলোচ্ছ্বাসে।”    

একটা উচ্চগ্রামে বাঁধা। এখানে ভাবনাকে মূলত দোলা দিয়েছে ধ্বনি। দুটো শব্দের কথা উল্লেখ করব— বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ। এটা শব্দজোড়েরও অধিক। তিনটি শব্দের জোড়। আপনি যেভাবেই উচ্চারণ করুন এর থেকে ধ্বনির একটা দীর্ঘসূত্রতার গ্রাফ আঁকা হয়ে যাবেই। আর কল্লোলোউচ্ছাসে। এটাও আপনি যেভাবেই উচ্চারণ করুন আপনার শ্বাসাঘাতে যুক্তবর্নে গিয়ে জোর পড়বেই।

 

ঙ)   প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্নপ্রান্তে তির্যক হয়ে পড়েছে।

       সম্মিলিত জনসংঘ আপন নাড়ীতে নাড়ীতে যেন শুনতে পেলে

       সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবানী--- মাতা, দ্বার খোলো।

       দ্বার খুলে গেল।

       মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,

       উষার কোলে যেন শুকতারা।

       দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।

       কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে—

       জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।

       সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী,জ্ঞানী এবং মূঢ়;

                                                                                

       উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে—জয় হোক মানুষের,

       ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।”

এখানে ভবিষ্যত প্রত্যয়ের ভাষা, স্বপ্নবুননের ভাষা, এই ভাষাবয়ন এমন যে একটা তরঙ্গায়িত ধ্বনি কম্পন আপনাকে প্লুত করবেই।

এইসময় কালে আরেকজনের কথা না-বললে বক্তব্য আধুরা রয়ে যাবে। তাঁকে ‘ছন্দের যাদুকর’ বলা হতো। সত্যি বলতে কি এই কবি ছোটোবেলায় তার কবিতার মাধ্যমে আমার একটা কান তৈরি করে দিয়েছিলেন। খুব সহজসরল কথ্যভাষা পাশাপাশি বসিয়ে এমন ধ্বনিগুণ সম্পন্ন পদ্য বা কবিতা যে লেখা যায়, করা যায়, তিনি তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

     ছিপখান তিনদাঁড়/ তিনজন মাল্লা

       চৌপর দিন-ভর / দ্যায় দূর পাল্লা।

                 পাড়ময় ঝোপঝাড়/ জঙ্গল,-জঞ্জাল,

                 জলময় শৈবাল / পান্নার টাঁকশাল”

 

বা,   চুপ চুপ – ওই ডুব

      দ্যায় পানকৌটি

      দ্যায় ডুব টুপ টুপ

      ঘোমটার বউটি!”  

এই যে ছন্দের চাল, তাতে শিশুমনে দোলা লাগবেই। অনুকার শব্দের ব্যবহার তুলবে ধ্বনিগুঞ্জন, আর ধ্বনিগত দিক থেকে এই যে বিটিং, তাতে ধ্বনিগুণের ফলে হয় আপনার শরীরে দুলুনি জাগবে নয়তো বিটের তালে তালে পায়ের পাতা পড়তে থাকবেই, যেমন গানে তাল দেন।  

 

এই কবিরই আরেকটা ধ্বনিসঞ্চালন কবিতায় মেশানো তুলে আনি।

 কার তরে এই শয্যা দাসী, রচিস আনন্দে

   হাতীর দাঁতের পালঙ্কে মোর দে রে আগুন দে।

   পুত্র যাহার বন্দিশালায় শিলায় শুয়ে, হায়

   ঘুম যাবে সে দুধের-ফেনা ফুলের-বিছানায়?

   কুমার যাহার উচিত কয়ে সয় অকথ্য ক্লেশ,

   সে কি রাজার মন ভোলাতে পরবে ফুলের বেশ?”

এখানে কিন্তু ছন্দনির্ভর ভাষায় সেই দুলুনি বা বিটিং টা নেই। আছে একটা দীর্ঘলয়তা, এর উচ্চারণগত ধ্বনিগুণ আপনাকে আবিষ্ট করবে। আপনি শুনতে উন্মুখ হবেন, ধীরে ধীরে স্থির হবেন।

 

আসি বাংলা কবিতার আরেক মাইলস্টোন জীবনানন্দ দাশ-এ – জীবনানন্দর কবিতায় আপনাকে খুঁজে-পিতে ধ্বনিগুণ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কবিতা আবিষ্কার করতে হবে। তার দুটো কারন আছে। প্রথমত তিনি কবিতায় শ্রাব্যতার চেয়ে দৃশ্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন অনেক বেশি, বিশেষত উপমার পর উপমা তুলে ধরে। দুই তিনি কবিতায় যে ছন্দ ব্যবহার করছেন তা অক্ষরবৃত্তে পয়ার মহাপয়ার, যা ছন্দের মাত্রাবৃত্তের যে দুলকিচাল তা থাকে না। বরং একটু লাচারে চলতে থাকা। কিছুটা উত্থান-পতনরহিত। তবু তাঁর ধ্বনিগুণ বিশিষ্ট দুটো কবিতাংশ তুলে এনে আর দু-চারটে কথা বলি।

ক) “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

    মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

    হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

    সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

    তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

    পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”

 

কী দাঁড়ালো? “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,”। আমরা পেলাম শব্দালংকার অনুপ্রাস। তার-কার-কার-শার ইত্যাদি। তবে ঈশ্বর-গুপ্তর মতো ‘আনা দরে আনা যায় কত আনারস’ এতটা লঘু নয়। পদের অনুপ্রাস নয়, পদ ও পদ-শেষাংশের অনুপ্রাস। এবং তাতেই যতটা ধ্বনি-গুঞ্জরণ বা ধ্বনিমাধুর্য।


খ) তাঁর ‘অন্ধকার’ কবিতাটার মধ্যে কিছু ধ্বনিগুণ বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। সেটা মূলত রিপিটেশনের জন্য। শব্দ, শব্দবন্ধ, বা বাক্যাংশের রিপিটেশন এই ধ্বনিকে সঞ্চালিত করে। যেমন-

“ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে—

     কোনদিন আর জাগব না জেনে

কোনদিন জাগব না আমি— কোনোদিন জাগব না আর—”  বা

 

“জানো না কি চাঁদ,

নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

জানো না কি নিশীথ,”         বা

 

“হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,

       হে হিম হাওয়া

আমাকে জাগাতে চাও কেন!”

এইরকমের পুনরাবৃত্তি। অবশ্য ভাব-ভাবনায়-চেতনায় কবি জীবনানন্দ যে সুররিয়ালিজমের প্রয়োগকারি ছিলেন বাংলা কবিতায়, তাতে দৃশ্যতার স্থান সর্বাগ্রে। হয়তো তাই ধ্বনিবিচারের নানা গুণ তাঁর কবিতায় সেভাবে মেলে না।

 

এক লাফে চলে আসি বারীন ঘোষালে, যিনি নিজেও একটা বিরাট লাফ মারতে চেয়েছিলেন, মেরেছেন। বাংলাকবিতার ভিলেন বলে নিজের ঘোষনার সঙ্গে অন্যরা বেশিরভাগই বিশ্বস্তও। তাঁর কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধ্বনিখেল দেখবার মতো। শ্রাব্যতা যে কবিতার একটা বিশেষ গুণ, তা তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর গদ্যেও। নয়া শব্দ তৈরি, শব্দ নিয়ে খেলা, শব্দের পানিং, শব্দজোড়, বাংলাভাষা ছাড়া অন্যভাষার প্রয়োগ, কিছু ক্ষেত্রে অনুপ্রাসের ব্যবহার, বাংলা বর্ণমালার এক বর্গের মধ্যে বর্ণের যে ধীর উচ্চমার্গিতা, ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে কবিতায় ধ্বণিগুনকে লিপ্ত করে রাখতে চেয়েছেন তিনি। আরেকটা বিষয় ভাবনার দিকে কবি বারীন ঘোষাল ‘অতিচেতনা’য় বিশ্বাসী এবং প্রত্যয়ী। অর্থাৎ সম্প্রসারিত চেতনা। সেটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভবিষ্যত, স্বপ্ন আর সম্ভাবনা। এখানে প্রাথমিক টুলস হিসেবে প্রয়োজন পড়ে ফ্যান্টাসির। কবি নিজেই বলেছেন। আর এসব অ্যাচিভ করতে হলে ধ্বনি-প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে এসে পড়ে। তিনটে পার্টে কবিতাংশ পড়ি। ১ম পার্টে যখন এই সব নীরিক্ষা করে একটা স্থানে পৌঁছেছেন- ‘হাসিস তরণী’ থেকে-

“ঝরণা পড়েছে কাছে উথলে উঠেছে দুধশোক

 শুধু কুটিকুটি হয় ছিঁড়ে তছনছ হয় আমিনা আমিনা

 গরু খা হারামজাদা আমার ছেলেকে দিস গোর ও কলিজা

 

 এত মুক্ত এত চাঁদমারি হেম চাঁদ ও মারির মাঝামাঝি

 চমকে ওঠে গুণ্ঠনে কুল্‌হারে প্রভাব্যাকরণ হস্টেলে

 যা দোজখে ভারুয়ার গুষ্টি তোরা আমি বলি ও আমিনা”

জোড়শব্দ, অনুকার শব্দ, খুব সামান্য অনুপ্রাস, সামান্য রিপিটেশন নিয়ে এই কাব্যভাষায়, সিনট্যাক্সেও কিছু বদল আছে। আর এসব মিলেই ধ্বনিসমৃদ্ধতা।

মধ্যপর্বে যখন তুঙ্গে তাঁর অভিযান— ‘বোরখাল্যান্ড থেকে’—

“একশূন্যটি আঁকা যাচ্ছে না যার মাত্রা উপূপদে

 এর মানে হল ঢেউ ওঠেনি লুনার আঃ

                         বর্ত

                            মা নেঢেউ

 আর মওত ফওত দুপায়ে দুই চাঁদনীম কালার সমেত

 সকালের সবাক ফুটেছে তোমার মুখে

                         হ্যালো ভগ্নিমা

 

 তো অপত্রিকায় অকলার আজিদিন

          রাহু কেতু বউ ছাড়া ছায়া কেবলম”

নতুন শব্দ পাচ্ছেন যার ধ্বনিস্বাতন্ত্র আলাদা হতে বাধ্য। শব্দ ভাঙা আছে বর্ত মা নেঢেউ। এর ধ্বনি অন্যখাতে বওয়া। ‘মওত ফওত’ ‘অপত্রিকায় অকলার আজিদিন’ অনুকার শব্দ, যার খেলা আগেই বলেছি। ছোট্ট অনুপ্রাস ‘সকালের সবাক’ তার কথাও আগে বলেছি। ভিন্ন ভাষার শব্দ ‘হ্যালো’, ‘কেবলম’ উচ্চারণে মাত্রা আলাদা। শব্দজোড়- ‘ভগ্নিমা’। উচ্চারণে ভঙ্গিমার কাছাকাছি হয়ে ধ্বনি প্রহেলিকা। এসব মিলিয়ে।


শেষপর্বে। ‘প্রণয়ধ্বনির সফটওয়্যার’। প্রণয়ের ধ্বনি।

“মাছরা তো এখন ফুটবেই কার্টুনে

 ফূটবে চোখের চমক ফিন ফিন ব্যাকুল বিশ্ব

 এবং সূর্যের উল্টোদিকে আসবো একদিন

 প্রান্তর ফ্রান্তর মনোরমাকে পালটে দেখা মারনোম

 

 মারনোম আমাকে বাজাচ্ছে এখন

 ষাড় পিঠ পাছা গোড়ালির কমন ছবিতে অস্পর্শ

 ওঠা জলের ওড়িয়া ঢেউ সন্ধ্যা শাঁখে

        বারকোষের বাঁকা ছায়ার উইন্ডমিল

                  শালিক

 

সফ্‌টওয়্যার এ পর্যন্ত

বাকিটা প্রণয়ধ্বনি বাজছে”

আশা করি এ-নিয়ে আর কথা বলতে হবে না। আমাকে এতক্ষণ ধ্বনির মধ্যে থাকতে দিয়ে আপনারা বধির হয়ে গেলেন কিনা জানার লোভ সামলাতে পারি না।

 

কবিতায় প্রাণ বা কবিতার প্রাণঃ

কবিতায় একটা প্রাণ থাকে যাকে আত্মা বলা যেতে পারে। যা দেখি তা তার বহিরঙ্গ, লিপিসমৃদ্ধ আকারগ্রস্ত, কবিতা সেখানে থাকে না। তাই কবিতার প্রাণ এই বহিরঙ্গে থাকে না। কবিতা থাকে আড়ালে, তাই কবিতার প্রাণভোমরাটিও থাকে আড়ালে অগোচরে। কিন্তু এই প্রাণ বা আত্মা না-থাকলে তা অন্তঃসারশূন্য একটা কাঠামো মাত্র। এসব কারণে আমার দুটো কথা মনে হয়। ক) কবিতার প্রাণভোমরাটি লুকিয়ে থাকে— কবিতাত্মারা গহীনে। যা নিরাকার এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কে চালান যায়, গোটা্টা অপরিবর্তিত না-থেকে। এ যেন প্রচুর প্রবেশদ্বার পেরিয়ে একটা সূক্ষতার দিকে যাত্রা। যেন কোটৌর মধ্যে আরেকটা কৌটো, আরও আরও, শেষত গিয়ে একটা প্রাণের রেখা, একটা প্রাণ-ভাবনা। এ যেন পেঁয়াজের পরতের পর পরত খুলে অন্তরে প্রবেশ। খ) কবিতার একটিই মাত্র প্রাণ না-থেকে তা অনেক প্রাণের সমাহার হতে পারে। তাই এতক্ষণ যে কেন্দ্রমুখী প্রাণ-চিন্তার কথা বলা হচ্ছে, সেই ধারণাটি পুরো ভেঙে প্রাণের বহরটা ছড়ানো-ছেটানো বা বহুপ্রাণ বহুভাবে প্রতীয়মান। প্রাণ হচ্ছে গোটা কবিতাটার চালিকা শক্তি। সূক্ষতার বহুকরণ। ভাবনার বীজে উৎসারিত যে প্রাণ, তাই কবিতার প্রাণভোমরা, যার ব্যতিরেকে কবিতা রসহীন, কঠিন, কঙ্কালসার কাঠামো মাত্র।

 

কবিতার নির্মাণঃ

কবিতার নির্মাণ একটি সচেতন প্রয়াস। এটি একটা প্রক্রিয়া যা মেধা ও বোধকেন্দ্রিক। এর নানা মত পথ কৌশল তরিকা। ব্যক্তিনির্ভর। কবিতাভাবনা হচ্ছে একটা আবেগ, ড্রাইভ, সূচনা, উৎস। আর নির্মাণ হচ্ছে একটা মনন-ভ্রমণ। বীজটি যদি একটা কুসুমকলি হয়, তবে নির্মাণটা হচ্ছে তার ব্লুমিং ও ব্লুজমিং। যেখানে আলো চাই (মেধার স্ফুরণ), তাপ চাই (বুদ্ধির দিপ্তী), জল চাই (রসসঞ্চার বা রসিক মনোভাব), বাতাস চাই (ফ্লেক্সেবিলিটি), চাই কৌশল (উপস্থাপনা গুণ)। সচেতন নির্মিতির পিছনে এসবই কাজ করে বলে আমার মনে হয়। যেন কুসুমকলির পূর্ণ বিকাশ শেষে একটা প্রস্ফুটিত ফুল।

ব্যস্‌, এই পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।




Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger