Recent Blog Posts

কবিতা নিয়ে দু-দিনের ক্যাম্প। প্রচুর ইন্টার‍্যাকশন, গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা পড়া, তার আলোচনা, কবিতাকেন্দ্রিক গদ্য এবং আরও অনেক অনেক কিছু। আর তারই নির্যাস নিয়ে এই রোয়াক সংখ্যা।


রোয়াকে
কবিতা পড়লেন চিত্তরঞ্জন হীরা 
আলোচনা করলেন সজল দাস, পার্থসারথি ভৌমিক, শঙ্খদীপ কর  

সূত্র ধরলেন উমাপদ কর

চিত্তরঞ্জন হীরা, দীর্ঘদিনের এক বন্ধু। বয়সে আমাদের কম কিন্তু চিন্তাচেতনায় আমাদের থেকে অনেক জায়গায় বড়। শুধু কবিতাই নয়, কবিতা বিষয়ক গদ্যও ও লেখে। কবিতাকে আইডেনিটিফাই করে, তার চিহ্ন বের করে আনা, ওর একটা প্রয়াস, এটা যদিও ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। স্বপন যেভাবে দ্যাখে, ভাবে বা বলে, তার ভঙ্গী আর আমার ভঙ্গী যেমন আলাদা, চিত্তর বা দেবাঞ্জনের ভঙ্গীও আলাদা এবং এটাই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। চিত্তকে আমি বলব, পুরনো কবিতা না পড়ে একেবারে ফ্রেশ কিছু লেখা থাকলে সেটা পড়তে।

 

চিত্তরঞ্জন হীরার কবিতা 

আবলুস

পালিশ হচ্ছে  চুইয়ে পড়া রাগে

জেগে উঠছে মোমডানার     

                                    বিরলও।

 

পায়ে পায়ে সূর্যের দিকে হেঁটে যাওয়া

                            খোলা তারুণ্য। 

ফেলে আসা ওম    

                  পালকের 

                          ডগাচ্ছে বাহারে।

 

 মুখে কারু কাচ টানা ।

 

অবিন্যাস

মনে হয়

মাঝে মাঝে মনেরও হয়।

 

যার যেখানে যাওয়ার না গিয়ে

 আমরা দেখে ফেলতে চাই

         কোনও কোনও শুরুর 

                         শেষ থেকে 

                                         এখনই।

 

মনপালা চলছে

                       হাওয়া লাগিয়ে।

 

অশ্রু

এখানে শুদ্ধ লাগাও 

 স্বরে   বর্ণ দাও 

                 বরণ করো।

 

ঘরে বাইরে যা হবার 

তা কেটে বেছে

সঙ্গে একটু সোহাগ দিলাম

               একেবারে ছপছপে।

 

তার হবে হবের অংশটুকু

আসলে       যা হবার নয়    তবুও                        

 

 অন্ধকার হেলান দিচ্ছে 

                              ভিজে গালে।

 

সাজ

প্রতিবার আমার ভাঁজ খুলে 

গোপন খুলে   

         ছাপাকণ্ঠ 

                      পাপড়ি মেলে দেয়।

 

প্রতিবার আহার সঙ্গে

          উহুর সঙ্গে  

                      ফুলগুলো‌।

 

প্রত‍্যেকের নিজস্ব টোল 

সেজে উঠছে 

                       নিজের মতো।

 

সঙ্গম

এই দ‍্যাখো কাজলপাড়ের ঝরোখা

দ‍্যাখো হলদে টোপ

                                    টুপুরে ভাসছে।

 

ভরভরন্ত চুলে দীর্ঘোপমা

সামান্য ঝুঁকে  

কোল দিচ্ছে মিলনকে

                    প্রথম নামে ডেকে।  

 

সমুদ্র

দুদিকে ফেটে   গড়িয়ে   অরণ্য গাইছে   

 দুপশলা    রাস্তার আদর। 

 

থেকে থেকে কণার অভ্রতা   তা দেয়

                           কিছুটা বাজে।

 

বেজে ওঠার আগে অবশ্য নেমে আসছিল

           আমাদের ভেজা রুমাল বেয়ে।

 

এখন নামছে অতিবেগুনি 

                        আলতো  হয়ে।

 

সূর্যাস্ত

দিনের কিছুটা ফিরে    থেকে যায়

             ঢেউ গোণে

                      তারা গোণে

আবার ছলকে দেয়      ইন্ধন।

 

চোখের তালুকে গুনগুন

 বারবার     ঠোঁট থেকে

                     নাভি থেকে    অন্ধ বরাবর।

 

প্রতিটি রাস্তার ত্রিভুজে 

ঝুলে থাকছে       নীল আলোর দীর্ঘ। 

 

তারিখ

দূরত্বের ফাঁস প্রতিদিন 

সূর্যোদয় দেখছে

               লতিয়ে

                     দুহাতের আগল ছেড়ে।

 

মিহিতাঁত  উঠলো উড়ু পাতায়

নিরুদ্দেশ উড়ছে

এক একটা দেশ বুনতেই    

                 একঢাল আকাশ।

 

ফিরতি পথ বারোঘর

                 কাঁটাতার ভাঙা।

 

স্নান

ঝুপ        এবারও গাইলো 

শ্মশান গাইলো   

          সমুদ্র গাইলো

তারপর কিছুটা ঝরনা টেনে 

                  গলা ছেড়ে

একেবারে আয়নার দিকে।

          

শুয়ে থাকা অস্তের ধারনা  

জল শুকোতেই পারেনা

                  বৃষ্টিমার পা থেকে।

 

স্নায়ু

ঘরে ঘরে নামতার চাঁদ    অবৈতনিক

শির বেয়ে শিরশির নেমে বেঘরগুলো।

 

তারপর ছোটহাতের বারান্দা 

                    একঝাঁক জোনাকি।

 

আর কোনও দমকা নেই  বায়না নেই

ঝুলে থাকা হসন্তের কোলে

                          পেণ্ডুলামটা।

 

অসমাপিকা

জলরঙের দরজা        

পাহারায়       যমজ পা

                          নিঃশব্দ    রঙও।

 

বয়স ভুলে যায়

কিছুটা পেরোলেই

           আমরা আবার পেয়ে যাব

                   বাঁদিকের জানলা।

 

এখন টিভি চলছে

     চোখে চোখে

                  নাদেখার সিরিজে…

 

আতস

এক একটা লুক প্রতিদিন 

এক একরকম।

 

অথচ আশ্চর্য লাগে

          ঘষাকাচ 

          নামছে ছায়া ধরেই। 

 

বোঝা যায় না

      কার মুখ

  মুখোশের ঠিক কোনদিকে !

 

একাঙ্ক

লাট খাওয়া মলাটের ধার ঘেঁষে

 বদল হচ্ছে পায়ের ওপার

      পারাপার বদলে নিচ্ছে নিশপিশ।

 

ঝুঁকে থাকে একবেলার ফেরিঘাট।

 

এখন আর সাঁতার উঠছে না

সাত তারের একটা ফিনফিনে বাজনা 

কে বলে দেবে 

এখানে জলের দরে বিকোচ্ছে

                          কতটা ড্রামাডোল !

 

মৃগয়া

যেন ধনুক ভেঙেছি

যেন পয়ার ভেঙে বেগমের টায়রা। 

 

একটা পলকযুদ্ধের মহড়া চলছে।

 

সভা নেই    সন্ধ্যাপাখি নেই

তবু যেভাবে এসে দাঁড়ায়

মাংসের গন্ধে পাগল হয়ে ওঠে

একটা দোফলা রাত্রি

                       গোটা পিকনিক।

 

আসক্তি

ভেতরচাপা আলো  

শ্বাস নিচ্ছে নাভি থেকে

কিন্তু নাভিশ্বাস নেই  

 আলোর ভেতর 

                 এককণা নির্বিকার।    

 

ধ্রুবকে তারা 

তারাকে অন্য একটা কিছু

যতবার ভাবছি

ভেসে উঠছে আকাশতরঙ্গ

ভেসে উঠছে       আলাদিন।

 

উমাপদ কর

আমি সজলকে অনুরোধ করব চিত্তর কবিতা নিয়ে কিছু বলতে।

 

সজল দাস

সমুদ্র কবিতাটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। আর চিত্তদা, আমার মনে হয়েছে তোমার এই লেখাগুলো একটা দেখা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। হয়তো দেখতে দেখতে যাচ্ছি আর সেগুলো আমার লেখায় উঠে আসছে। জার্নিটাই লেখা। আর সংহত লেখার ধরন আমার মনে হয়নি।

 

উমাপদ কর

পার্থ বলো এবার।

 

পার্থসারথি ভৌমিক

চিত্তদার লেখা আমি বহুদিন থেকেই পড়ছি। চিত্তদার এখনকার লেখার মধ্যে আমি সেই বদলের ভাব লক্ষ্য করেছি। এই কবিতাগুলো সেই বদলের মধ্যেই পড়ে। আমরা গতদিনের ক্যাম্পে আমরা যা যা আলোচনা করেছি, তার প্রায় সবকিছুই এই কবিতায় রয়েছে। ধ্বনি রয়েছে। ধ্বনি থেকে সংগীত যেভাবে আসে, তার ইঙ্গিত রয়েছে। রাগ বলে কথাটা রয়েছে। তাছাড়া শব্দের সঙ্গে ক্রিয়াপদের একটা বিক্রিয়া ঘটিয়ে দেওয়া, যেমন শব্দ ভাঙা আছে। যেমন কারুকাজ শব্দটা না বলে কারু কাচটা না বলেছে। এই যে প্ররোচিত করেই আবার অন্যদিকে পাঠককে ফিরিয়ে আনা, কারুকাজে যেতে গিয়েই পাঠক ধাক্কা খেয়ে কাচে ফিরে আসছে, তাকে নতুন করে প্রবাহিত করেছে। এই যেমন, মনে হয় মাঝে মাঝে মনেরও হয়। অনেককিছু বলা যায়, যেমন ব্যকরণগত দিক দিয়ে বলা যায়, মন কর্তা হয়ে গেল, মনে-র পরে র বসিয়ে অনেক কিছু ভাবনার উসকানি, খুব ছোট কথায়। এইখানে শুদ্ধ, কোমল এই শব্দগুলো, সাধারণত গানে ব্যবহার হয়, এটাকে কবিতায় এনে ফেলেছেন। আমি কবিতার অর্থও করতে পারি। আবার সংগীতের দিকে ভাবনা নিয়ে গিয়ে সাতটা স্বরের মধ্যে যেকোনো একটা নির্বাচন করে, গানের দিকে যাত্রার পথটা খুলে দিতে পারি। সারেগামাপাধানির মধ্যে যেকোনো একটা। শুধু রে, বা শুধু গা ,স্বাধীনভাবে নির্বাচন করে পাঠককে সেই জায়গাটায় পৌঁছে দিচ্ছেন। এই যে একটা কথা, প্রত্যেকের নিজস্ব টোল সেজে উঠছে। কিছু শব্দের একাধিক মানে আছে। তা খুঁজে ব্যবহার করা। এই টোল শব্দটার একটা মানে পাঠশালা হতে পারে। আবার মানুষের মুখে সৌন্দর্যবৃদ্ধি সূচক গালের টোল হতে পারে। এই দুটো আলাদা অর্থ নিয়েই আমরা পরের লাইনে অন্ততপক্ষে দুটো যাত্রা শুরু করতে পারি। যেমন, টোপ টুপুরে ভাসছে। টুপুর শব্দটাকে টাপুর থেকে আলাদা করে বসানো। আর টোপকে নিয়ে আসা ট এর অনুপ্রাস কাজে লাগানোর জন্য। টোপ শব্দটা নিয়ে আসা অর্থে দিগন্ত খুলে দেওয়া। তারপর টুপুরে ভাসছে বলে সেই জায়গাটাকে সান্ত করে দেওয়া। এই যে অসাধারণ একটা শব্দ, শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, বৃষ্টিমা, এটা আমি বলতে না হলেও আলাদা করে জানতে চাইতাম, এই বৃষ্টিমা শব্দটা কীভাবে লিখেছেন? একসাথে, নাকি বৃষ্টির পর মা আলাদা করে লিখেছেন? কবিতাগুলো হাতে নিয়ে বলছি বলে দেখতে পেলাম, বৃষ্টিমার পা থেকে। এই শব্দটা থেকে তর্জমা, গরিমা অনেক শব্দ খুঁজে বেড়াতে পারি। বেশি প্ররোচিত করাচ্ছে ধ্বনি। এটা আমাকে অনেকগুলো আলাদা শব্দের দিকে যাত্রা করাচ্ছে। এই বৃষ্টিমা শব্দটা আমার আজকের প্রাপ্তি হয়ে রইল। ভীষণ ভালো লেগেছে।

 

শঙ্খদীপ কর

এই আমরা বলিনা, যে শব্দকে তার রেফারেন্স ছাড়িয়ে, ব্যবহার করা। শব্দকে তার মিথ ছাড়িয়ে দেওয়ার জায়গা, যেমন এক জায়গায় ড্রামাডোল ব্যবহার করেছ, এক জায়গায় বৃষ্টিমা ব্যবহার করেছ, কারু কাচ টানা, এই শব্দকে তার কনসেপ্ট ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে দেওয়া এবং তার মধ্যে দিয়ে কোথাও না কোথাও, ভেতরে চিনচিন করে ওঠা, যে এটা কী হলো! কিছু জায়গায় চমক লাগছে, এবং সেটা পেরিয়ে যাওয়াটাও আছে। কাল থেকে যে আলোচনা হচ্ছে, এবং আমরা যা বারবার বলি, যে লেখা হলো যা, মানে, আমরা বলিনা, অনেক কথা শব্দে যায়না, স্পিরিটে যায়, এই কবিতার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়। যেটা লেখা আছে সেটা পেরিয়ে যাওয়া। এই পেরিয়ে যাওয়ার রেফারেন্সগুলো, ধ্বনির কথা বলা হচ্ছে যেমন, একটা ধ্বনি কীভাবে জার্নি স্টার্ট করতে পারে, পাঠক হিসেবে তা আমরা পেয়েছি। খুব ভালো লেগেছে। প্রথমে চমক লেগেছে। তারপরে চমক পেরিয়ে কবিতা। আরও পরে আবার রিপিট করেছি মনে মনে। ভালো লেগেছে। খুব ভালো ।



Post a Comment from facebook

Post a Comment from Blogger