সূত্র ধরলেন উমাপদ কর
কবিতা পড়বে জয়দীপ মৈত্র। ওর সম্পর্কে দুটো কথা বলে নিই। ও প্রায় আট দশ বছর কবিতা লিখছে, যদি প্রকাশ সময়টা
অনেক পরে। যাপনচিত্র থেকে ওর প্রথম বইটা বেরোয়, আর দ্বিতীয়
বইটা রেহেলের বাকিদের সঙ্গে সাতটা বইয়ের সিরিজে।
মাঝখানে দীর্ঘ দিন লেখেনি। একটা বিশেষ চিন্তা-চেতনা ভাবের মধ্যে ও আছে।
কিন্তু আমরা যারা ওর কাছ থেকে আরও লেখা পেতে চাই, আমাদের প্রত্যাশাটা সবসময়ই
থাকে। ইদানিং পুনরায় লিখছে এবং কয়েকটি জায়গায় পাঠানোর
জন্য আমি লেখা চাওয়াতে আমাকে বিমুখ করেনি। ফলে রিসেন্টলি কয়েকটা
জায়গায় ওর লেখা প্রকাশিতও হয়েছে।
এখন যে লেখাগুলো ও পড়বে, তার সবগুলো ও প্রকাশের সময় রেহেলে দিতে চাইছে না।
ওর এই সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কিছু লেখা ও নিশ্চয়ই
দেবে। কোনগুলো দেবে আর কোনগুলো দেবেনা সেটা ওই ঠিক করবে। যাইহোক, পড় জয়দীপ।
জয়দীপ মৈত্রের কবিতা
১.
জলের অর্থ কী?
এ প্রশ্ন কখনও হারানো পোকার মত নয়
এ চলার অর্থ কী?
ধরো জল এতদূর গড়ালো
কখনও তোমার পায়ে চাপা না পড়া
একটা পোকা হারিয়ে গেছে
২.
পাথর কাকে যেন সরায়
বাকি পাথরের কাছে
এই প্লবতা শুধুই দেহভ্রম
অবশিষ্ট ভ্রম অন্যমনস্ক
মীমাংসা ছাড়াই দেহ এতটা সাঁতার কেটেছে
যেন ব্যাধ জানে
জলে পাখির ছায়া কখন স্থির হবে
মাছ আর মাংস হয়তো এভাবেই আলাদা হয়েছিলো
৩.
কী এক মাধ্যাকর্ষণ চেপে বসে থাকা!
এই পৃথিবীর তামাম আপেলগুলো কামড়ের পর
হালকা হয়ে যায়। যেন খিদেই তাকে
ভারী করে গাছে এনেছিলো
তুমি আমি আমাদের নৌকোভর্তি মাছ
এসমস্তই সেই আপেলবাগানের অংশ
যেন মানুষ আগত কিছুর পরমুহূর্ত থেকেই
শান্তভাবে খিদেহীন হবে
৪.
তোমারই ময়ূর আমাদের সাপকে ধাওয়া করেছিল
আমাদের জন্মকালীন বৃষ্টির দাগ পেখমে ঘন হয়ে
ঘন হয়ে সেই শাশ্বতবোধ
ঘন হয়ে মাছের স্মৃতিলোপ ও নৌকোময় বিষ
নিবীর্য রঙের পাশে পড়েছিলো ঈশ্বরের চোখ
যেন ময়ূরের পেখমগুলি জল রচনায় অন্ধ হয়ে যাবে
৫.
ঘড়ির পেছনে বসে তুমি সমুদ্র নিলে
মা খুঁজেই সারা
এখন অল্প ব্যথা জলের দিকে যায়
সব জল মায়ের শরীরে
পা মুড়ে বসা নিষেধ। মাটি
ছোঁয়া নিষেধ।
খাওয়ার পাতা বাবা ডুবুরির আসনে ফেলে দিচ্ছে।
উমাপদ কর
স্বপন জয়দীপের কবিতা নিয়ে কিছু বল
স্বপন রায়
কিছু কবিতা শুনে ভাল লাগল। কিছু কবিতা ভাল। কিছু কবিতা একটু দুরত্ব তৈরি
করেছে। এতক্ষন যা শুনলাম আমি তাতে কোনও তাৎক্ষনিক ব্যাপার না। কিছু কবিতা আমার
দুরত্ব তৈরি করে দিল। এবং আমাকে পড়তে হবে। ও আমরা যাকে বলি ল্যাটারাল থিংকিং এর
কবিতা সেটা লেখে। একটা ভাবনা আছে তাকে সমান্তরাল একটা ভাবনার সাথে জুড়ে দেয়। আর
সেই ভাবনা বিন্দুতে গিয়ে ও নানা রকম খেলা খেলে। আর সেই খেলা গুলো কি বলব আর কি ছড়িয়ে
পড়ে না, টু দি পয়েন্ট৷
যেমন এখানে দ্যাখো,
“জলের অর্থ কী?
এ প্রশ্ন কখনও হারানো পোকার
মত নয়”
তারপর আবার প্রশ্ন,
“এ চলার অর্থ কী?”
আমি ভাবছিলাম এত প্রশ্ন কেন
করছে, তারপর শেষে এসে ও যেটা করল,
“ধরো জল এতদূর গড়ালো
কখনও তোমার পায়ে চাপা না পড়া
একটা পোকা হারিয়ে গেছে ”
মানে, শোনার পর কথা হারিয়ে গেল। ডিসট্যান্ট সিগনালের মতো। উত্তর দিল একটা,
কিন্তু এমনভাবে বাক্যের রি-আরেঞ্জমেন্ট করে দিল, এটা টানলো খুব কোথাও।
“ধরো জল এতদূর গড়ালো
কখনও তোমার পায়ে চাপা না পড়া
একটা পোকা হারিয়ে গেছে ”
ও কোনও নির্দিষ্ট মাপ বলছে না, অথচ বাংলা ভাষাকে ও এমনভাবে রিঅ্যারেঞ্জ করল
লেখাটায় যেটা স্বদেশ দা করতেন, স্বদেশ দা ঠিক এভাবেই করতেন না, কিন্তু এই
রিঅ্যারেঞ্জ আমার খুব ভালো লাগে। খুব ভালো লিখেছিস। খুব ভালো।
যেমন এই কবিতাটা, অসাধারণ একটা লেখা, পুরোটাই পড়ছি আমি
“পাথর কাকে যেন সরায়
বাকি পাথরের কাছে
এই প্লবতা শুধুই দেহভ্রম
অবশিষ্ট ভ্রম অন্যমনস্ক
মীমাংসা ছাড়াই দেহ এতটা সাঁতার কেটেছে
যেন ব্যাধ জানে
জলে পাখির ছায়া কখন স্থির হবে”
এ পর্যন্ত পড়ার পর আমি ভাবছিলাম, খুব ভালো, হ্যাঁ, ঠিক আছে,
তারপর ও স্ট্রোক দিল একটা, সেখানে এসে
কবিতাটার পুরো মুডটা ও ভেঙে দিল। আর দক্ষতার সাথে ভাঙলে কবিতার অন্তর্নিহিত
সৌন্দর্য ফুটে বেরোয়।
“পাখির ছায়া কখন স্থির হবে”
এই অব্দি ভালো লেখা, কিন্তু তারপরেই অসাধারণ একটা মাস্টারস্ট্রোক যখন লিখছে,
“মাছ আর মাংস হয়তো এভাবেই
আলাদা হয়েছিলো”
এটাই। একটা লাইনেই ধরেছে এবং
অপরিসীম দক্ষতায় সাজিয়েছে, হ্যাটস অফ। দারুণ।
আমি এই দুটোই এখন বললাম। এবার অন্য কিছু বলি। ওর কিছু লেখায় একটা আবেদন আছে
যাতে সরাসরি ঢুকে যাওয়া যায়। কিন্তু তাৎক্ষনিক ভাললাগা বা এরকম কিছু ছিল না। আবার
এমন দু-তিনটে কবিতা আছে যার মধ্যে কিছু জটিলতার খেলা আছে। যেগুলো হয়তো আরও পড়তে হবে।
উমাপদ কর
এবং প্রচুর দার্শনিক তত্ত্ব…
স্বপন রায়
হ্যাঁ, দার্শনিক তত্ত্বের রেফারেন্স আছে এবং কিছু কিছু লেখায় সেটা
স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে।
উমাপদ কর
চিত্ত বল
চিত্তরঞ্জন হীরা
ওর কবিতার মধ্যে আরও কবিতা আছে। যে কবিতা নিয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারব না।
একটা জিনিসই বলার, ও যে দক্ষ কবি এটা ওর শব্দ ও তার ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ভীষনভাবে
প্রমানিত। আর যখনই ও এই লেখাগুলো ছাপতে দিতে চাইনা বলেছিল, তখন থেকেই ও
অ্যাটেনশনটা টেনেছে। কেন? কেন সেটা এই কবিতাগুলো শুনতে শুনতে আমার স্পষ্ট হল। এই
কবিতাগুলো নিয়ে ওর নিজের এখনও ভাবার আছে বলে মনে হয়। কারন যে স্পেসগুলো ও তৈরি করে
রেখেছে, কবিতার মধ্যে আরও এত কবিতা রয়েছে, দু-চারবার পড়ার পর আমি যদি লিখতে বসি,
তখন আমার নিজের অনেক অনেক কথা আসবে। ঠিক মীমাংসা আর অমীমাংসাকে ও কয়েকটা
শব্দের মধ্যে যেভাবে ব্যবহার করল খুব ভালো লাগলো। কিছু বলার নেই। আর হ্যাঁ ওর কবিতা পড়তে হবে। এরপর থেকে যখনই ওর কবিতা
আমি কোথাও পড়বো যত্ন নিয়ে পড়বো, এটুকু বলতে পারি।
Post a Comment